শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিস এবং চিকিৎসা
ডা. শামীমা সুলতানা : শৈশবে যেসব অসুস্থতা শিশুর মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে ডায়াবেটিস মেলাইটাস তার মধ্যে অন্যতম। শরীরের কোষগুলোকে বেঁচে থাকতে ও জৈবনিক বিক্রিয়াগুলো পরিচালিত করতে শক্তি দরকার; যা কোষগুলো গ্লুকোজ থেকে পায়।
অগ্নাশয় থেকে নিঃসৃত হরমোন ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং কোষের ভিতরে গ্লুকোজের প্রবেশ ও কোষের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। ইনসুলিন ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। যদি কোনো কারণে দেহে ইনসুলিনের পরিমাণ কমে যায় বা ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে না পারে তবে গ্লুকোজ দেহকোষের বাইরে জমা হয় এবং একটা সময় পর এই গ্লুকোজ প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে আসতে থাকে।
অধিকাংশ শিশুর ডায়াবেটিস হয় অগ্নাশয়ের প্রয়োজনীয় পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে (টাইপ-১)। এছাড়া ইনসুলিন যথেষ্ট পরিমাণে নিঃসৃত হওয়ার পরও যদি তার মাধ্যমে কাজ করতে না পারে তাহলে ডায়াবেটিস (টাইপ-২) হয়। এ ক্ষেত্রে যেসব কোষের ওপর ইনসুলিন কাজ করে তার সমস্যা থাকতে পারে বা ইনসুলিনের নিজেরও গাঠনিক সমস্যা থাকতে পারে। এসব রোগীর দেহে ইনসুলিনের বিপক্ষে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। আবার কিছু শিশু-কিশোর টাইপ-১ ও টাইপ-২ উভয় প্রকার ডায়াবেটিসেই একসঙ্গে আক্রান্ত হয়। তাই প্রাথমিক অবস্থা থেকেই চিকিৎসা করতে হবে।
১ বছর বয়সের কমবয়সী শিশুদের ডায়াবেটিস হতে দেখা যায় না। ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ডায়াবেটিসে ভোগার বেশ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।
পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে টাইপ১ ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯৮-২০০১ এই ৩ বছর আগের ৩ বছরের চেয়ে শতকরা ৪০ ভাগ টাইপ১ ডায়াবেটিস হতে দেখা গেছে।
শিশুদের সাধারণত টাইপ২ ডায়াবেটিস হয় না। তবে উন্নয়নকামী দেশগুলোর মানুষের দৈহিক স্থূলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে টাইপ২ ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে।
বাংলাদেশে বারডেম ছাড়া ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও গবেষণার আর কোন প্রতিষ্ঠান নেই। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে যদি তালিকা তৈরি করা হতো, তবে অনেক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু-কিশোরকে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা যেত। আমাদের দেশে যেসব কিশোরের ডায়াবেটিস শনাক্ত করা গেছে তারা পিডিপিডি শ্রেণীর এবং তাদের অগ্ন্যাশয়ে পাথর ছিল। এটাও দেখা যাচ্ছে, দিন দিন শিশু-কিশোরদের মধ্যে টাইপ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি আতঙ্কজনক।
শিশুদের ডায়াবেটিসের লক্ষণাদি বড়দের মতোই। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রকট হলো ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, অধিক পিপাসা ও ক্ষুধা পাওয়া, দৈহিক দুর্বলতা ও খাওয়ার রুচি বেশি থাকা সত্ত্বেও ওজন কমতে থাকা ইত্যাদি। শিশুর বেড়ে উঠার সময়ের মধ্যে কোন একবার যদি ডায়াবেটিস হয় তবে তা যেমন তাকে সারা জীবন বহন করতে হবে তেমনি এই ডায়াবেটিস তার দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। এর ফলে তার বয়োসন্ধিকালও দেরিতে আসতে পারে।
শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিস চিকিৎসা করার আগে ৪টি লক্ষ্য স্থির করা হয়। (১) ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিসের ক্ষেত্রে নিরাপদ ও জটিলতামুক্ত আরোগ্য লাভের ব্যবহার করা (২) রক্তের গ্লুকোজ খুব বেশি যেন না কমে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া (৩) দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা যতটা কমানো যায় তার ব্যবস্থা করা (৪) শিশুর স্বাভাবিক দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য যতটা সম্ভব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া।
ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘসূত্রী রোগ। এটা যে কতটা জটিলতা তৈরি করতে পারে তা এখনও পুরোপুরি নির্ধারিত হয়নি। কিন্তু দেহের এমন কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই যা ডায়াবেটিসের জটিলতায় আক্রান্ত হয় না। উদাহরণস্বরূপ দৃষ্টিশক্তি হারানো বা অন্ধত্বের প্রধান কারণ হলো ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস থেকে রেটিনোপ্যাথি, নেফ্রোপ্যাথি ও নিউরোপ্যাথি হয়। হৃদপিন্ডের ধমনীর অসুখ, হার্ট অ্যাটাক হতে পারে, বিভিন্ন রকম কর্মবিরোধী প্রক্রিয়া চালু থাকায় ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।
শিশু-কিশোরদের টাইপ২ ডায়াবেটিস হলে বয়স্কদের মতো তারাও হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকসহ আরও কিছু ভয়াবহ পরিণতির শিকার হয়। আর এসব জটিলতা বেশ কম বয়সেই দেখা দেয়। বাংলাদেশের শিশুরাও এ ধরনের সমস্যায় ভোগে। অভিজাত শ্রেণীর স্থূলকায় শিশুরা টাইপ২ ডায়াবেটিসে অনেক বেশি আক্রান্ত হয়। নাদুস-নুদুস হওয়া ও শারীরিক পরিশ্রম না করা আভিজাত্য ও সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। এরূপ ভ্রান্ত ধারণা মূল্যবান শিশুদের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক পুষ্টি পরিকল্পনা। প্রথমবার যাদের ডায়াবেটিস আছে বলে শনাক্ত করা হয় তাদের অন্ততপক্ষে অর্ধেক শুধু সঠিক পুষ্টি এবং সুষ্ঠু, উপযোগী ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বাকি অর্ধেকের রক্তে গ্লুকোজ কমানোর জন্য মুখে খাবার ট্যাবলেট লাগতে পারে। তাদের সবার জন্যই পরিমিত ও নিয়মিত ব্যায়াম অপরিহার্য। কারও কারও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ত্বকের নিচে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন প্রয়োজন হতে পারে। তবে ওষুধ যে রকমই নেয়া হোক না কেন খাওয়া-দাওয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলা এবং নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যায়াম করা সবচেয়ে জরুরি।
জীবনযাপনকে একটি সুশৃঙ্খল ধারার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে, যা পরবর্তী সারাটা জীবন পালনীয়। জীবনঘাতী জটিলতা এড়ানোর জন্য রোগের শুরুতেই চিকিৎসা শুরু করে দিতে হবে। আমাদের দেশে যেসব শিশু-কিশোর ডায়াবেটিসে ভোগে, তাদের বেশিরভাগই ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা নিয়েই প্রথমবার চিকিৎসকের কাছে যায়। এর ফল যথেষ্ট ভাল হয় না। সঠিক চিকিৎসা ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন ও পরিমিত পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারলে ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশু-কিশোররাও প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। তাই এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন থাকা জরুরি।
লেখক : এমবিবিএস, এমডি (এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম)