শিশুর মানসিক বিকাশ ঠিকমতো হচ্ছে তো?
সেলিনা শেলী : শিশুর মানসিক বিকাশ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা তা খেয়াল রাখাটা জরুরি। একটু সতর্ক এবং চোখ-কান খোলা রাখলে বিষয়টি স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়।
তানিশা খেতে চায় না, পড়তেও চায় না। মা বিউটি বিষয়টা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। সব সময়ই তিনি সমাধানের উপায় ভাবতে থাকেন। আর ভাবতে ভাবতেই তিনি আবিষ্কার করেছেন নতুন এক কৌশল। তানিশা মায়ের কথা না শুনলেই মা ভয় দেখাচ্ছেন। পড়তে না বসলে ভূতে ধরবে, না খেলে সাপে কামড় দেবে।
প্রথম প্রথম কাজ হয়েছিল ভালোই। কিন্তু এখন হিতে বিপরীত হওয়ার দশা। সব সময় তানিশা ভয়ে তটস্থ থাকে। তার মধ্যে জড়তা এসেছে। সে আর ছোটাছুটি করে না। স্কুলে গিয়েও সে আগের মতো খেলে না। সার্বক্ষণিক যেন ভয় তাড়া করে তাকে। মা এখন পড়েছেন নতুন সমস্যায়।
অন্যদিকে কার্টুনের ভক্ত আদর স্কুল থেকে ফিরেই টিভির রিমোট নিয়ে বসে পড়ে। টম অ্যান্ড জেরি, মিকি মাউস, ডিজনিসহ তার পছন্দের তালিকা অনেক দীর্ঘ। কৌতূহলবশত একদিন ভয়ের সিনেমা দেখে তো অবস্থা খারাপ। ভয়ে সারা রাত ঘুমাতে পারল না। বাথরুমে যেতে হলেও মাকে দরকার। সারাক্ষণ যেন সিনেমার অ্যানাকোন্ডা মাথার মধ্যে।
কোমলমতি শিশুরা অনেক সময় গল্প শুনে বা ছবি দেখে ভয় পায়, আর এই ভয় শিশুর মনের গভীরে ছাপ ফেলে। ফলে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ হয় বাধাগ্রস্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের কোনো কাজ করানোর জন্য ভয় দেখালে তা তার মনে গেঁথে যায়। এর ফলে ওই শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয় এবং আত্মবিশ্বাস কমে যায়। এর ফলে শিশুর সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে না। তাই শিশুদের কোনোভাবেই ভয় দেখানো উচিত নয়।
এ রকম পারিবারিক কলহের চাপে আদরের মতো অনেক শিশুর স্বাভাবিক জীবনই অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ঘটনায় শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেসব শিশু মা-বাবার মনোমালিন্য দেখতে দেখতে বড় হয়, তারা হতাশ, অসামাজিক ও সহিংস হয়ে ওঠে। নানা অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকে তারা। তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। ফলে মনঃসংযোগের ঘাটতিও দেখা দেয়। মানসিক রোগ ও ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা ঘটতে পারে : ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ-২০১৬’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, দেশে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত। এমন ঘটনা আবার মেয়েশিশুর তুলনায় ছেলেশিশুর মধ্যে বেশি। মেয়েশিশুদের ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশের
পাশাপাশি ১৯ দশমিক ২১ শতাংশ ছেলেশিশু মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকে। গবেষকরা বলেন, ‘শিশুদের ওপর মানসিক আঘাতের প্রভাব অনেক দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষতিকর। যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মানসিক আঘাত শিশুর পরবর্তী জীবনকে বাধগ্রস্ত করে, আবেগজাত সমস্যায় আক্রান্ত করে।’
প্রতিদিন মা-বাবার ঝগড়ার প্রত্যক্ষদর্শী অনেক শিশুর মধ্যে পরবর্তীকালে ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতাও দেখা যায়। সমাজে মানিয়ে চলতে অসুবিধা হয় তাদের। গর্ভকালে যেসব মা নির্যাতনের শিকার হন অথবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন, তাদের সন্তানও জন্মের পর নানা জটিলতায় ভোগে।
নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই মেডিক্যাল সেন্টারের ট্রমাটিক স্ট্রেস স্টাডিজ বিভাগে সম্পন্ন এক গবেষণার দেখা যায়, মাতৃগর্ভে থাকার সময় যাদের মা মানসিক আঘাতের শিকার হয়েছিলেন, সেই শিশুরা সহজেই মানসিক চাপে ভেঙে পড়ে এবং তাদের মধ্যে অ্যাংজাইটি বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
নিরাপত্তাহীনতা ও বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি : ইউনিসেফের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘পারিবারিক কলহের মধ্যে বেড়ে ওঠা অথবা মাকে নির্যাতিত হতে দেখা শিশুদের জীবনের প্রথম দিকের বছরগুলোতে তারা হয় বিশেষভাবে অরক্ষিত, অসহায়। এসব শিশু পরবর্তীকালে হিংস্র, ঝুঁকিপূর্ণ বা অপরাধমূলক আচরণ করতে পারে। বিষণ্নতা বা তীব্র দুশ্চিন্তায় ভোগার ঝুঁকিতেও পড়তে পারে এসব শিশু।’
শিশুর মানসিক বিকাশে মা-বাবার ভালোবাসা, সান্নিধ্যের কোনো বিকল্প নেই। পরিবারে মাকে নির্যাতিত হতে দেখলে শিশু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। শিশুর মা-বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ ও মধুর সম্পর্ক শিশুর মধ্যে পরম সুখ ও নিরাপত্তাবোধ জাগায়। বাবাকেও তাই শিশুর মানসিক বিকাশে ভূমিকা রাখতে হবে।
ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমীন রহমান জানান, ‘পারিবারিক নির্যাতন দেখে বেড়ে ওঠা শিশুরা এমন ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে যে, অন্যকে আঘাত করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তাই সে যে কাউকে আঘাত করতে পারে। আবার সেও অন্যের কাছ থেকে আঘাত পেতে পারে। তাই বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক বৃদ্ধি হলো শারীরিক বিকাশ। আর মানসিক বিকাশ হলো আচার-ব্যবহার, চিন্তা-চেতনা, কথা বলা, অনুভূতি ও ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষমতা অর্জন। শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ছাড়া শিশু তথা মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। গর্ভকালীন মায়ের অপুষ্টি, মা-বাবার মধ্যে কলহ, পারিবারিক নির্যাতন, মাদকাসক্তি, থাইরয়েড ও অন্যান্য হরমোনের আধিক্য ও অভাব, জন্মগত ত্রুটি, প্রসবকালীন জটিলতা, শব্দদূষণ, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ ইত্যাদি কারণে তার বিকাশ ব্যাহত হতে পারে।