শিশুকিশোরদের ঝুঁকিপূর্ণ ইন্টারনেট ব্যবহার
মনোজিৎকুমার দাস
প্রযুক্তির উন্নতি আজ চরম শিখরে পৌঁছেছে। আজকে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বায়িত পৃথিবী সবার হাতের মুঠোয় এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ ইন্টারনেটের আবিষ্কার। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, এনড্রোয়েড মোবাইল ফোন, আইফোন, ট্যাব, স্মার্টফোন ইত্যাদি আজ শিশু-কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী এমনকি বয়স্কদের হাতেও পৌঁছেছে। চোখের সামনে অনলাইনে খুলে যাচ্ছে অজানা বিস্ময়, না-দেখা নতুন ভুবন।
এ পৃথিবীর মানুষ, জন্তু-জানোয়ার, প্রাকৃতিক সম্পদ, ম্যান মেইড বস্তু সামগ্রীর মধ্যে দুটো শক্তি আছে। একটি হচ্ছে ইতিবাচক শক্তি আর একটি হচ্ছে নেতিবাচক শক্তি। সদ্ব্যবহারের ফলে মানুষ হয়ে উঠে দেবতাতুল্য, আবার সেই মানুষই একসময় দানব হয়ে ওঠে যখন সে তার শক্তিকে অপব্যবহার করে। আগুন দূর করে আঁধারকে, আর এ আগুনেই ভস্মীভূত হয় সম্পদ। মানুষের তৈরি ডিনামাইট মানুষের কল্যাণে কাজ করে, আবার এ ডিনামাইটই যুদ্ধে মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে আজ বিশ্বে বহুমাত্রিক কল্যাণ সাধিত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তথ্যপ্রযুক্তি আধুনিক প্রযুক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। তথ্যপ্রযুক্তির নবতর সংযোজন ইন্টারনেট। স্বাভাবিকভাবেই ইন্টারনেটেরও আছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক। এ ইতিবাচক দিকের ফলে আজ সারা বিশ্ব একটি গ্লোবাল ভিলেজে রূপান্তরিত হয়েছে। অন্যদিকে, ইন্টারনেটের নেতিবাচক ব্যবহারের ফলে নানা ধরনের অপর্কম ঘটছে এটাও সত্য।
বাংলাদেশে ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে ইন্টারনেট সেবা। ইন্টারনেটের সদ্ব্যবহারের ফলে মানুষের যেমন উপকার হচ্ছে, অন্যদিকে এক শ্রেণির অপব্যবহারকারীদের হাতে ইন্টারনেটের মারাত্মক অপব্যবহার হচ্ছে। ইন্টারনেটের অপব্যবহারের ফলে সমাজে সহিংসতা, যৌন অপকর্ম, যৌন নির্যাতন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশু-কিশোর-কিশোরীরা ইন্টারনেটের অপব্যবহারের প্রধান শিকার। তাদের হাতে সহজে ইন্টারনেট ব্যবহারের উপকরণ পৌঁছানোর ফলে এ অপব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজের শিশু, কিশোর-কিশোরীরা তাদের জ্ঞানভাণ্ডারকে ঋদ্ধ করার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারের দিকনির্দেশনা শিক্ষক, পিতা-মাতা কারো কাছ থেকেই পাচ্ছে না। সত্যি কথা বলতে, বর্তমান সরকার প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই কম্পিউটার ও ল্যাপটপ পৌঁছে দেওয়ায় ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরাও। রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মুষ্টিমেয় স্কুল-কলেজ ছাড়া ইন্টারনেট সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান ছাত্রীছাত্রীদের কতটা দেওয়া হচ্ছে তা অনুসন্ধান করে দেখা উচিত। প্রকৃতপক্ষে, স্কুল-কলেজ থেকে ইন্টারনেট ব্যবহারের সঠিক নির্দেশনা পেয়ে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা অনলাইনের অপব্যহার করছে বলে জানা যায়। অনিরাপদ ব্যবহার তাদের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। অনেক শিশু-কিশোরই অনলাইনে যৌন নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছে।
ক্যাসপারস্কি ল্যাবের পক্ষ থকে ১০০০ শিশুর উপর গবেষণা চালিয়ে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড মিরর পত্রিকায় তথ্য দিয়েছে উন্নত দেশে ১০ বছর বয়সী শিশুরা সক্রিয়ভাবে মা-বাবার কাছে তাদের অনলাইন কার্যক্রম লুকানোর চেষ্টা করছে। দেখা গেছে, ১০ বছর বয়সী ৫১ শতাংশ শিশুর নিজের ট্যাবলেট এবং ৩৩ শতাংশের স্মার্টফোন রয়েছে। এর মধ্যে ৪২ শতাংশ শিশু এমন যারা বিশ্বাস করে তারা অনলাইনে কী করছে, সেটি মা-বাবার কাছ থেকে লুকানোর মতো জ্ঞান এবং দক্ষতা তাদের রয়েছে।
১৩ বছর বয়স থেকে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে। ক্যাসপারস্কি আরো জানায় ১০ শতাংশ শিশু তারা অনলাইনে কী করছে সেটি নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে না। জরিপে আরো দেখা গেছে, যে সকল শিশুর ওপর ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ম করে রাখা হয়েছে তার ২৭ শতাংশ বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।
শিশুদের গোপনে ইন্টারনেটের ব্যবহারের ফলে ৪২ শতাংশ শিশু বাজে ভাষা এবং ২৮ শতাংশ হিংস্রতা শিখছে। এ ছাড়াও ১১ শতাংশ শিশু পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত।
ক্যাসপারস্কি ল্যাবের প্রধান নিরাপত্তা গবেষক ডেভিড এম বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে প্রথম ডিজিটাল প্রজন্ম হিসেবে শিশুদের জন্য ইন্টারনেটের অন্ধকার দিকটাও প্রবেশ করাটা প্রচণ্ড সহজ।’ ১০ বছর বয়সী শিশু ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় এমন ডিভাইস ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। কিন্তু মা-বাবা তাদের এ বিষয়টি উপেক্ষা করেন, যেটি তাদেরকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে ১০ বছর বয়সী পাঁচজন শিশুর একজন অনলাইনের কারো দ্বারা মর্মাহত হলে তার সম্পর্কে নোংরা কিছু পোস্ট করতে দু’বার চিন্তা করে না। শিশুদেরকে অনলাইন থেকে সুরক্ষিত রাখতে মা-বাবাকে আগে থেকেই তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার বলে মনে করেন তিনি। আমাদের দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার চালু হওয়ায় এ ভীতি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর সমকাল এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘ইন্টারনেটের অপব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের যৌন নির্যাতন’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেন, ‘দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে ইন্টারনেট সেবা। চোখের সামনে অনলাইনে খুলে যাচ্ছে অজানা বিস্ময়, না-দেখা নতুন জগৎ। আবার এর অপব্যবহারও হচ্ছে। তা ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের শিশুরা এ অপব্যবহারের প্রধান শিকার। কারণ সীমাহীন কৌতূহল নিয়ে নতুন কিছু জানার আগ্রহে তারা ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে। এর অনিরাপদ ব্যবহার তাদের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। অনেক শিশু-কিশোরই অনলাইনে যৌন নির্যাতন ও হয়রানির শিকার। নির্যাতিত এ শিশুদের আইনি সেবা গ্রহণে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। আবার আইন থাকলেও নেই এর সঠিক প্রয়োগ। তাই এ জাতীয় অপরাধ বাড়ছে। এ কারণে অনলাইনে শিশু যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের অপরাধপ্রবণতাও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে।’ গোলটেবিল আলোচনায় উঠে আসে, দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন, বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষক, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য ও ইন্টারনেট সেবাদাতাসহ সমাজের সবার সচেতনতাই অনলাইনে শিশু যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ করতে পারে। বক্তারা বলেন- তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় ইন্টারনেটের বিস্তৃতি রুদ্ধ করা যাবে না। শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারও বন্ধ করা ঠিক হবে না। তবে ইন্টারনেটে যৌন কনটেন্টের ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য নিয়মতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে এর অপব্যবহার কমবে। কমবে অনলাইনে শিশুদের যৌন নির্যাতন।
বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য সচেতনতা সৃষ্টিতে যৌথভাবে কাজ করবে ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। দু’পক্ষের মধ্যে এতদসংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সম্প্রতি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ইন্টারনেট ও অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত শিশু ও তরুণ ছাত্রছাত্রীদের প্রবেশ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ১৫-১৮ বয়সের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার প্রতি বছরে ৩.৩% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অনলাইনে প্রদর্শিত বিভিন্ন আপত্তিকর ও যৌন বিষয় তাদের গোচরীভূত হওয়ায় ঝুঁকি বাড়ছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর আগামী দিনগুলোতে আমাদের শিশু ও কিশোর প্রজন্মকে মানসিক ও শারীরিকভাবে ইন্টারনেটের বিভিন্ন ক্ষতিকারক প্রভাব হতে সুরক্ষাকল্পে সচেতনতা সৃষ্টি, গাইডলাইন প্রণয়ন, আইসিটি সংক্রান্ত পলিসি ড্রাফটিং এবং ইন্টারনেট ব্রাউজিং নির্দেশিকা প্রণয়ন ও প্রতিপালনে সহায়তা দেবে। আশার কথা, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ নৈতিকতা অভিযানের অংশ হিসেবে পাঁচ শ’র বেশি পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) জানিয়েছে, শিশুদের ওপর কুপ্রভাবের কথা বিবেচনা করে স্থানীয় ইন্টারনেট সেবাদাতাদের পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট ব্লক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ বিটিআরসির মুখপাত্র সরোয়ার আলম লিখেছেন, ‘পর্নোগ্রাফির কুফল থেকে আমাদের শিশুদের এবং তরুণ প্রজন্মকে রক্ষায় আমরা পর্নো ওয়েবসাইটগুলো নিষিদ্ধ করছি। আমাদের সংস্কৃতি এবং নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়নের অংশ হিসেবে এটা করা হচ্ছে। আমরা একটি কমিটি গঠন করেছিলাম যারা ৫৬০টি পর্নো সাইটের তালিকা প্রস্তুত করেছে। এ কমিটি স্থানীয় আইএসপিদের সাইটগুলো ব্লক করতে বলেছে।’
বাংলাদেশের ১৬০ মিলিয়ন অধিবাসীর মধ্যে এক তৃতীয়াংশের ইন্টারনেটে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে যাদের মধ্যে কয়েক মিলিয়ন শিশু-কিশোরও রয়েছে। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ এবং ট্যাবলেটে অনেকেই এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে। বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এক ফেসবুক পোস্টে জানান, ‘বাইরে থেকে জেনারেটেড বা ইউটিউবে এসব কনটেন্ট পুরোপুরি ব্লক করা যায় না- যদি সত্তর ভাগও করা যায়, মানুষ উপকৃত হবে।’
কিছু অসৎ ছেলেমেয়ে ও তরুণ ইন্টারনেটকে অপব্যবহার করার জন্য সংখ্যগরিষ্ঠ শিশু-কিশোর ও তরুণদের ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করা অবশ্যই যেতে পারে না, তা সরকার অনুধাবন করেছে এটা আশার কথা। আমাদের দেশের ইন্টারনেট সেবাকে ইতিবাচক কাজে ব্যবহার করার জন্য সরকারের এ সব পদক্ষেপের ফলে ইন্টারনেটের অপব্যবহার বন্ধ হবে বলে আশা করি।