লালু :সর্বকনিষ্ঠ বীরপ্রতীক এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা
বাঙালির ইতিহাসের একটি স্মরণীয় বছর ১৯৭১। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করে এদেশ শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতাকামী মানুষ। সে যুদ্ধ ছিলো মুক্তিযুদ্ধ। আর যারা যুদ্ধ করেছিল তাদের বলা হতো মুক্তিফৌজ বা মুক্তিযোদ্ধা। এই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ। এরা ছিলেন ছাত্র-শিক্ষক, যুবক, বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিক, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, সেনাবাহিনীর জোয়ান, কৃষক-শ্রমিক তথা স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ। মা-বোনেরাও অংশ নিয়েছিল। অংশ নিয়েছিল দামাল কিশোর ছেলেরাও।
পুরো আট মাস যুদ্ধ চলেছিল। আমাদের অপর পক্ষে ছিল পাকিস্তানি ঘাগু সৈন্যরা। তারা ১৯৪৭ সালের পর থেকেই আমাদের দাবিয়ে রাখা শুরু করেছিল। ১৯৫২ সালে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে কেড়ে নেবার ফন্দি এঁটেছিল তারা। অত্যাচার-নিপীড়ন সইতে না পেরে দেশের মানুষ লড়াই শুরু করলো সেই একাত্তরে। পাকিস্তানি সৈন্যরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর হত্যা নির্যাতন শুরু করে দেশটা দখলে নিয়ে গেল। আর বাঙালি সন্তানেরা বসে রইল না। তারাও হাতে অস্ত্র নিল। সমগ্র বাংলাদেশে যুদ্ধ চললো। সেই যুদ্ধই স্বাধীনতার যুদ্ধ। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস আর ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ আমরা বিজয় দিবস পালন করি। ঐদিন পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের এদেশিয় দোসররা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আমরা যুদ্ধে বিজয় অর্জন করি। আমাদের দেশ সম্পূর্ণ হানাদারমুক্ত হয়। গোটা বিশ্ব জেনে যায় বাঙালি জাতির বীরত্বের কথা, স্বাধীনতার কথা।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। মান-সম্মান, সম্ভ্রম হারিয়েছেন মা-বোনেরা। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে বাংলা মায়ের এসব সন্তানের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং প্রাণ বিসর্জন আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। তাঁরা আমাদের গৌরব। তাদের বীরত্বে গৌরবগাঁথা ধারণ করেই আমাদের মানচিত্র এবং আমরা বেঁচে আছি। আমাদের স্বাধীনতার এক কিশোর বীর সৈনিকের নাম শহীদুল ইসলাম। ডাকনাম লালু। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁর বীরত্বের কাহিনি ও জীবন-কাহিনি রূপকথার গল্পের মতো। কিন্তু সে গল্প অতীব সত্য। চন্দ্র-সূর্যের মতো দুঃসাহসী সেই কিশোর লালুর ইতিহাস আমাদের ইতিহাসের অংশ। ১৯৭১ সালে লালুর বয়স মাত্র দশ-বার বছর। দরিদ্র কৃষকের সন্তান। লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। টাঙ্গাইলের গোপালপুরে উপজেলার সূতী গ্রামের এক দামাল কিশোর। গাঁয়ের মেঠোপথ, ঝোপঝাড়, পুকুরে সাঁতার কাটা এবং কিশোর বন্ধুদের নিয়ে নদী-খাল পুকুর পাড়ে হৈ-হুল্লোড় করে কৈশোরের দিনগুলো কাটছিল। একদিন সেই কিশোর লালু দেখলো মানুষগুলোর ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। সূতী গ্রামের অদূরে গোপালপুর থানার আশেপাশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাক সৈন্যরা বাঙালিদের মারছে। লালু পালাতে পালাতে এলো কেরামজানী জাওয়াল স্কুল মাঠে। সেখানে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী দলবল নিয়ে পাকসেনা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। লালু এক বুক সাহস নিয়ে তাদের কাছে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করার আবদার জানাল। লালুর সাহস ও বায়না দেখে তারা প্রথমে হেসে ফেলে এবং অবাক হন। কিন্তু লালু নাছোড়বান্দা। যুদ্ধে সে যাবেই। একসময় ফুট-ফরমাশ খাটানোর লক্ষ্যে তাকে দলে ভর্তি করিয়ে নেয়া হলো। কিছুদিনের মধ্যে পাঠানো হলো ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য। প্রশিক্ষণ নিয়ে লালু ফিরে এলো মাতৃভূমি উদ্ধারের জন্য। ইতিমধ্যে তার সংবাদ স্থানীয় বাহিনীর প্রধান আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর কাছে পৌঁছে যায়।
লালু অনেক যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। গ্রেনেড নিয়ে থানা আক্রমণ করেছে। ছদ্মবেশে পাকসেনার খবর সংগ্রহ করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গোপালপুরের থানা দখলের পুরো কৃতিত্বটা তারই। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলে ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুলে আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তাঁর বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দেন। লালুও সেদিন অন্যদের সাথে বঙ্গবন্ধুর হাতে জমা দেন অস্ত্র। বঙ্গবন্ধু ক্ষুদে মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে অবাক হন এবং কোলে তুলে নিয়ে মঞ্চে বসান। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সে সময় মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা টাঙ্গাইলে কিশোর লালু তার প্রধান অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকীর সাথে জেনারেল অরোরাকে স্বাগতম জানান।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে লালু ফিরে আসে গ্রামে। গ্রামে এসে একমাত্র ভাইকেও খুঁজে পায় না। শৈশবেই মা-বাবা মারা গেছে। লালু এখন একা। কোথায় যাবে। কে দেবে তাকে আশ্রয় ও খাদ্য-খাবার। মুক্তিযুদ্ধের সকল কিশোরযোদ্ধা এবার জীবনযুদ্ধে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। সহযোদ্ধাদের কোনো খবর নেই। বয়স হয়নি চাকরি করার। একদিন প্রাণের কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ছুটে এলো ঢাকায়। ঢাকার এসে ঠেলাগাড়ি ঠেলা, রাজমিস্ত্রী ও সোয়ারীঘাটের কুলিগিরি তাঁর ভাগ্যে জুটল। একদিন সোয়ারীঘাট ছেড়ে চলে এলো কমলাপুর। এখানে লালু দীর্ঘ কয়েক বছর কুলিগিরি করেন। এরপর আরও কয়েক বছর একটি হোটেলে বাবুর্চির সহকারি হিসেবে কাজ করে। লালুর তখন বয়স হয়েছে। বিয়ে করেছে। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঘর-সংসার। কিন্তু ১৯৯৭ সালে লালু ভীষণ অসুখে পড়ে মুমূর্ষু অবস্থা। অনেক কষ্ট করে ঠিকানা জোগাড় করে ছুটে গেছে কৈশোরের ‘লিডার’ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কাছে। লালুকে দেখে বঙ্গবীর প্রথমে চিনতে পারেননি। পরে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন এবং সুচিকিত্সার ব্যবস্থা করলেন।
লালুর বেঁচে ওঠার পরবর্তী ঘটনা আশ্চর্যজনক। মুক্তিযুদ্ধের কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল বাংলাদেশ সরকারের ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত গেজেটে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিসেনাদের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। লালুর নাম রয়েছে ৪২৬ জন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে। তার নম্বর ৪২৫। তাঁর নাম ছাপা হয়েছে শহীদ ইসলাম, প্রযত্নে:আব্দুল কাদের সিদ্দিক, টাঙ্গাইল। লালুর ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবটির সংবাদ সাথে সাথে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং সবাই জানতে পারে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। খবর পড়ে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী লালুকে দপ্তরে ডেকে পাঠান এবং তাকে সম্মানিত করেন। লালুর দুঃখ, আমাদের দুঃখ মুক্তিযুদ্ধের বীর সন্তানকে দেয়া খেতাবটির সংবাদ জানানো হয়নি। ৩০ বছর পর সে জানতে পেরেছে এবং দেশবাসীর ভালোবাসা শ্রদ্ধা পেয়েছে। আনন্দের সংবাদ সেই খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তাঁর একমাত্র হারিয়ে যাওয়া ভাই ফিরে আসেন লালুর ঠিকানায়।
লালু ঢাকার মীরপুরে মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন প্রকল্পের মাধ্যমে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু তাঁর জীবন সংগ্রাম শেষ হয়নি। বীরপ্রতীক শহীদুল ইসলাম লালু আমাদের গর্ব। বাংলা মায়ের বীর সন্তান। শহীদুল ইসলাম লালু ২০০৯ সালের ২৫ মে মৃত্যুবরণ করেন। লালুর স্ত্রী মালা তাঁর সন্তানদের নিয়ে বর্তমানে মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের একটি বাঁশের ঘরে বসবাস করছে।