গল্প বলার মাধ্যমে শিশুর সহজ শেখা

কিশোর বাংলা প্রতিবেদন: ছোট শিশুরা শেখার ক্ষেত্রে মনোযোগী ও সক্রিয় হয়। গল্প বলার মাধ্যমে শিশুর শেখা সহজ হয়। তাদের মধ্যে যদি আগ্রহ তৈরী করা যায় তবে তারা অনেক ভাল অংশগ্রহনকারী হয়। জ্ঞান ও ভাষা শেখার কাজে তারা অর্থপূর্ণভাবে অংশ নেয়।

শিশুরা যে ভাষায় কথা বলে কিংবা যে অঙ্গভঙ্গি করে সেটি মূলত বড়দের অনুকরন করে। যে কারনে শিশুদের জ্ঞান ও ভাষা শেখানোর কাজে নিয়োজিত প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে অনেক বেশী অভিব্যক্তিময়, সাড়ামূলক ও আনন্দদায়ক ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়।

শিশুকে ভাষা শেখানোর অন্যতম সহজ উপায় হলো গল্প বলা এবং সেই গল্প আবার শিশুর কাছ থেকে শোনা। গবেষনায় দেখা যায় শিশু গল্প শোনা ও গল্প বলার মধ্য দিয়ে অনেক নতুন নতুন শব্দ শিখতে ও ব্যবহার করতে পারে। এমনকি অনেক জটিল বাক্যও তারা বলতে শিখে। গুছিয়ে কথা বলতে পারে। মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে।

শিশুরগল্প আকারে শিশুরা কোন কিছু সবচেয়ে ভাল মনে রাখতে পারে। গল্প বলা বিষয়টিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে এর যে আকর্ষন শক্তি তাতে কোন কিছু মনে রাখা, আমোদিত হওয়া, সৃজনশীলতা, শেখা ও জানা অনেক সহজ হয়ে যায়। ছোট শিশুদের জ্ঞান ও ভাষা শেখানোয় উচ্চস্বরে পড়া ও গল্প বলা উভয় পদ্ধতিই খুব কার্যকরী।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমাদের অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন,সরকারী কিংবা বেসরকারী শিশু প্রতিষ্ঠানে কোথাও কোথাও পাঠক্রমে গল্প বিষয়টিকে রাখা হলেও গল্প বলার পরিবেশ কিংবা গল্প বলার কৌশল জানা না থাকায় বিষয়টি শিশুদের আকৃষ্ট করতে পারে না। শৈশবে বাড়িতে যৌথপরিবারে দাদাদাদী,নানা-নানী কিংবা অন্যকেউ এবং একক পরিবারে মা-বাবা শিশুকে অনেক ধরনের গল্প শোনায় কিন্তু স্কুলে গল্প বলার ঘটনা সেভাবে ঘটে না। মনে রাখতে হবে গল্প বলা শিশুদের জন্য শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম নয়। শিশুরা গল্প শুনতে ও বলতে ভালবাসে এটা তাদের জন্য আনন্দের। আর আনন্দের বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে কাশ রুমে পড়ার সঙ্গে মিলিয়ে শিশুদের যদি মজার মজার গল্প শোনানো যায় এবং সেই গল্পগুলো পুনরায় তাদের কাছ থেকে শোনা যায় তবে অল্প পরিশ্রমেই ছোট শিশুদের ভাষা শেখানো যায়।

বইয়ে গল্প পড়া আর গল্প শোনা এই দুইয়ের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। কেউ যখন গল্প বলে তখন সেটি অনেক বেশী অনানুষ্ঠানিক হয়। বইয়ের পৃষ্ঠায় ছাপানো শব্দের মতো হয় না। বরং গল্পবলিয়ের ভাষা,অঙ্গভঙ্গি, মুখভঙ্গি ও চোখের ভাষা সবমিলিয়ে পুরো গল্পটি যিনি শোনেন তার কাছে জীবন্ত হয়। তিনি যেন সবকিছু তার চোখের সামনে ঘটতে দেখেন। এ কারনে গল্প বলা শিশুর ভাষা শেখায় জোরালো ভূমিকা পালন করে। তখন সে জটিল বাক্যও তৈরী করতে শিখে।

ভাষার কাজ হলো যোগাযোগ ঘটানো। একজন মানুষ অন্য আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ভাষা ব্যবহার করে। গল্পবলিয়ের ভাষা ব্যবহার ও গল্প দুয়ে মিলে এমন একটি পরিবেশ তৈরী হয় যা শিশু মনকে আন্দোলিত করে। তখন তারা গল্প শোনার পর নিজেরাই সেই গল্পটি বলতে পারে। এভাবে গল্প বলতে গিয়ে দেখা যায় শিশু যে শব্দ ও ভাষা শুনেছে নিজে বলার সময় নিজে থেকে নতুন শব্দ ও বাক্য বিন্যাস করছে। নিজের ভাষায় গল্পটি বলতে গিয়ে ভাষার উপর তাদের দখল তৈরী হয়। গল্প বলা শিশুকে গল্প লিখতে উৎসাহিত করে।

শিশুরযখন ছোট ছোট শিশুদের গল্প শোনান তখন গল্পের চরিত্রগুলো এমনভাবে ফুটিয়ে তোলেন যেন তার শ্রোতারা সহজেই বুঝতে পারে। নানা মুখভঙ্গি,অঙ্গভঙ্গি ও ছবি একে তারা গল্পটি এমনভাষায় বলেন যে শিশুরা সহজেই আমোদিত হয়। তারা আগ্রহ নিয়ে শোনে ও প্রশ্ন করে। অর্থাৎ শিশুরা গল্পে পুরোপুরি মিশে যায়। এর মাধ্যমে শিশুদের মাঝে গুছিয়ে কথা বলা ও মনের ভাব প্রকাশ করার সামর্থ্য তৈরী হয়।শিশুদের উপযোগী এবং বারবার বললেও মন ভরে না এমন গল্প শিশুদের বারবার শোনানো যেতে পারে। এ ধরনের গল্প শুনে শিশুরা কান্ত হয় না এবং আগ্রহ হারায় না।

সঠিক গল্প বাছাই করা সম্ভব হলে গল্পের মাধ্যমে ছোট শিশুকে অনেক কিছুই শেখানো যায়। এই ধরনের গল্প বলার সময় দেখা যায় পুনরাবৃত্তিমুলক শব্দ বা বাক্য প্রথমবারের পরে যতবার ব্যবহার হচ্ছে শিশুরা নিজ থেকেই সেই শব্দ বা বাক্য বলছে।

গল্প শোনার মাধ্যমে শিশু শব্দ আকারে ভাষা শোনে যা তাকে ভাষা শিখতে আগ্রহী করে তোলে। গল্প শোনা ও গল্প বলার মাধ্যমে তারা গুছিয়ে কথা বলতে কিংবা নিজের ভাষায় একই গল্প শোনাতে পারে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে এখন কম্পিউটার ও ইন্টানেটের মাধ্যমে শিশুরা গল্প ছবি আকারে দেখতেও পারে। ছবি ও শব্দসহ গল্প কম্পিউটার, টেলিভিশনে দেখা আর একজন গল্প বলিয়ের কাছ থেকে শোনার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। ইন্টারনেট, কম্পিউটার, টেলিভিশন কোনভাবেই শিশুকে ব্যক্তিগতভাবে গল্পের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারে না যা একজন গল্পবলিয়ে করতে পারেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে শিশুকে গল্পের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নিতে পারেন। পুরো কাজটি তিনি গল্প বলার মধ্য দিয়ে করেন। যা শিশুর শেখায় অনেক বেশী শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে।

সক্রিয় শ্রোতা হিসেবে শিশুরা যখন মিলেমিশে নিজেও গল্প বানাতে শুরু করে তখন শিশুরা নিজের ভাষায় কথা বলা শুরু করে। এভাবে শিশুদের ভাষাজ্ঞান সমৃদ্ধ হয়। এর পর গল্প বলা শেষে গল্পের আঙ্গিকে যে প্রশ্নগুলো করা হয় শিশুরা স্বতস্ফূর্তভাবে তাতে অংশ নেয়। এ সময়ে সমাজের নানা অংশ থেকে আগত শিশুরা তাদের নিজেদের মতো করে গল্পের ব্যাখ্যা দেয় এবং গল্পের সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে বের কেরে। এ সময় তারা গল্পটি নিজের মতো করে পুনরায় বলে।

শোনা গল্পটি শিশুরা যখন নিজের ভাষায় পুনরায় বর্ণনা করে তখন শব্দ ও বাক্যের ধারনাগুলো অর্জন করে।  বারবার একই গল্প বললে শিশুদের অংশ নেয়ার হারও বাড়ে। এ সময় তারা নিজেদের মতো করে গল্পের কাঠামো, চরিত্র ও বর্ননা বদলায়।

গল্প বলা শিশুদের কল্পনা শক্তি বাড়ায়। গল্প শুনতে শুনতে কিংবা বলতে গিয়ে শিশুরা কল্পনার জগৎ তৈরী করে যেখানকার সবকিছুই তারা দেখতে পায়। এভাবে শিশু প্রথমে শোনে, এরপর গল্প শুনতে শুনতে গল্প বলায় অংশ নেয় এবং সবশেষে শিশু নিজেই গল্পবলিয়ে হয়।

শিশুরা যখন গল্প বলা শুরু করে তখন যে তারা স্কুলেই গল্প বলতে ভালবাসে তা নয়। তারা বাড়িতে এসেও গল্প বলে। মনে রাখতে হবে গল্প বলার জন্য শিশুকে কখনো জোর করা যাবে না। সে যা কিছুই করুক না কেন সেটা স্বতস্ফুর্তভাবে করতে দিতে হবে। শিশুরা যখন গল্প বলবে তখন প্রশ্ন করে তাদেরকে উৎসাহিত করতে পারেন। যেমন জিঙ্গাসা করতে পারেন , এরপর কি হলো? কিংবা তারপর তারা কি করলো? গল্প মোতাবেক প্রশ্ন করে গল্পটি শেষ করতে সহায়তা করতে হবে।

একসময় দেখা যায় শিশু গল্পের কাঠামো ঠিক রেখে নিজের মতো করে শব্দ ও বাক্য বলছে। এভাবে বলতে বলতে তার মধ্যে আরো বেশী আত্মবিশ্বাস তৈরী হয়। তখন সে নিজ থেকেই গল্প বানাতে শুরু করে। এভাবে তার কল্পনার জগত যত প্রসারিত হয় ততোই সে নতুন নতুন গল্প তৈরী করে। একপর্যায়ে তারা গল্প শুধু মুখে বলা নয় লিখতেও শুরু করে। এভাবে তারা নিজের তৈরী গল্প অন্যকে শোনায় এবং লিখিত ফরম্যাটে গল্পগুলো পরবর্তীতে বারবার নিজেরা পড়ে। এসময় তার মনে সৃষ্টি করার আনন্দ তৈরী হয়। শিশুরা গল্প লিখেই থেমে যায় না অনেক সময় তারা গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে ছবি আঁকে।

গল্প বলা ও গল্প শোনার মধ্য দিয়ে শিশু নিজেই গল্প বানাতে শুরু করে। একসময় শিশু গল্পের কাঠামো পরিবর্তন করতে শিখে। এভাবে শিশু ভাষা শেখে। তবে কে কতটা শিখবে সেটি নির্দিষ্ট শিশুর বয়স ও মেধার উপর নির্ভর করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *