কিশোরবাংলাপ্রতিবেদন: তেরো বছরের রোহিঙ্গা শিশু নবী হোসেন। আগে কখনও নদী দেখেনি সে। জানে না সাঁতারও। প্রতিবেশীরা যখন সাঁতরে নাফ নদী পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি নেয় তখন নিরুপায় হয়ে একটি তেলের ড্রাম ধরে পানিতে নেমে পড়ে সেও। প্রায় আড়াই মাইল ভেসে অবশেষে বাংলাদেশ উপকূলে আসে নবী।
মিয়ানমারে নির্মম নির্যাতনের মুখে পড়ে জীবন বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গারা। প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে নৌকায়, তেলের ড্রামে ভেসে বা সাঁতরে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে তারা। নবী হোসেন ৩ নভেম্বর তেলের ড্রামে চেপে নাফ নদী অতিক্রম করে। কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছানোর পরও তাকে হলুদ ড্রামটি আঁকড়ে ধরে থাকতে দেখা যায়। নবী বলে, ‘আমার শুধু ভয় হচ্ছিল যে বোধহয় মরে যাব। মনে হচ্ছিল আজকেই বুঝি জীবনের শেষ দিন।’
নবী জানায়, তার বাবা-মা এখনও মিয়ানমারে। তারা কেমন আছেন সে জানে না। আবার তারাও জানে না যে, সে বেঁচে আছে বা বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। কারণ সে কোনোভাবেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না।
নবী আরও জানায়, তার বাবা একজন কৃষক। তিনি পান চাষ করেন। মিয়ানমারে পাহাড়ের পাদদেশে তাদের গ্রাম ছিল। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে সে চতুর্থ। নবী কখনও স্কুলেও যায়নি।
সে জানায়, এক মাস আগে মিয়ানমার সেনা ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা নির্বিচারে হত্যা, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ ও বাড়িঘরে লুটতরাজ শুরু করে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় তারা। নবীর পরিবার পালিয়ে নদীর উপকূলে এসে জড়ো হয়। কিন্তু নৌকা ভাড়া এবং দালালদের দেয়ার মতো তাদের কোনো টাকা ছিল না। এদিকে দিনের পর দিন তাদের খাবার শেষ হতে থাকে।
চতুর্থ দিন নবী তার বাবা-মাকে জানাল, সে সাঁতার কেটে বাংলাদেশে পাড়ি দিতে চায়। প্রথমে তারা এতে রাজি হননি। কারণ তাদের বড় ছেলে দুই মাস আগে একইভাবে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু তার খোঁজ তারা এখনও জানেন না। সে বেঁচে আছে কিনা মারা গেছে কিছুই জানেন না তারা।
কিন্তু খাবার শেষ হতে থাকায় একপর্যায়ে ২৩ জনের একটি দলের সঙ্গে নবীকে ছেড়ে দেন তার বাবা-মা। ৩ নভেম্বর বিকালে তেলের ড্রাম নিয়ে তারা নদীতে নেমে পড়ে। এর আগে নবীসহ অন্যরা তাদের বুকের সঙ্গে হলুদ রঙের তেলের ড্রাম বেঁধে নেয়।
নদীর পানি লবণাক্ত হওয়ায় সাঁতারের সময় শরীরে নানা সমস্যা তৈরি করলেও নবী সেদিকে নজর দেয়নি। অবশেষে সন্ধ্যার দিকে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত অবস্থায় শাহপরীর দ্বীপে এসে পৌঁছায় তারা। নবী এখন বাংলাদেশে অন্যান্য ৪০ হাজার শিশুদের সঙ্গে থাকছে। এভাবে গত এক সপ্তাহে কয়েক ডজন রোহিঙ্গা শিশু ও যুবক হলুদ রঙের তেলের ড্রামে ভেসে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসে। অনেক রোহিঙ্গা সাঁতার কেটে পার হচ্ছে। যারা সাঁতার জানে না তারা শরীরের সঙ্গে তেলের ড্রাম বেঁধে নেমে পড়ছে পানিতে।