সংস্কৃতির বিকাশ ছোটবেলা থেকেই

পুরো পৃথিবী জুড়েই ছড়িয়ে আছে হাজারো বিষ্ময়, হাজারো নাম-জানা না-জানা বিষ্ময়কর উপাদান। তেমনি মানুষের চারপাশে অনেক বিস্ময় ছড়িয়ে আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে শিশুরা। শিশুদের নিয়ে প্রায় সবাই তাদের ভাবনা, উপলব্ধি প্রকাশ করে আসছেন প্রাচীনকাল থেকে। আমরা  এর প্রতিফলন দেখতে পাই সাহিত্যে, মনোবিজ্ঞানে, শিল্পে। অথচ শিশু সম্পর্কে মানুষের আবেগ  যতটুকু, দায়িত্ববোধ আসলে ততটুকু গভীর নয়। শিশুর অন্তরে ঘুমিয়ে থাকা একজন শিশুর পিতাকে মানুষ প্রত্যাশা করে, কিন্তু সেই ভবিষ্যত শিশুর পিতাকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সঠিক দায়িত্ববোধ আমাদের মধ্যে নেই। একটি শিশুকে পরিচর্যা করতে হয় বাগানের  গোলাপ গাছের মত। শুধুমাত্র সঠিক পরিচর্যা করতে পারলেই সেই শিশু একদিন একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে, সমাজের জন্য ভুমিকা রাখে। একটি শিশুকে ছোটবেলা থেকে যা শিক্ষা দেওয়া হয় সে সেভাবেই গড়ে উঠে। একটা শিশু বড় হয়ে কি হবে তা আসলে নির্ভর করে তার অভিজ্ঞতার জগতের উপর, আর তার অভিজ্ঞতার জগত সমৃদ্ধ হওয়া নির্ভর করে তার চারপাশের পরিবেশের উপর। প্রতিদিনই সে যতবড় হতে থাকে তার অভিজ্ঞতা ততই বাড়তে থাকে।

শিশুরা যদি সুস্থ্য সংস্কৃতির চর্চা করে, তবে অবশ্যই সেটা তার সঠিক মেধাবিকাশে কাজে লাগবে। সঠিক মেধাবিকাশের মাধ্যমেই একটা শিশু ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে। দিন দিন সুস্থ্য সংস্কৃতির চর্চা কমে যাচ্ছে। আমরা বিভিন্ন অপসংস্কৃতির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছি। যা শিশুদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। টিভি খুললেই দেখা যায় ভারতীয় চ্যানেলের ছড়াছড়ি। এসব ভারতীয় অপসংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়ছে। ইদানীংকালের একটি আলোচিত সামাজিক সমস্যা-ইভ টিজিং, যা আসলে এসব অপসংস্কৃতির প্রভাব। ডরায়মোন নামের একটি জাপানী কার্টুন বাংলাদেশে হিন্দী ভাষায় সম্প্রচার করা হয়, অনেক ছোট ছেলে-মেয়েরা বসে বসে টিভিতে ডরায়মোন দেখে। ইদানীং দেখা গেছে তাদের মধ্যে বেশীরভাগ বাচ্চাকাচ্চারাই বাংলার চাইতে হিন্দীতে কথা বলতে বেশি পছন্দ করে। অর্থাৎ, আমরা বিদেশী সংস্কৃতির প্রতি বেশী ঝুকে পড়ছি, যা আমাদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিশুদেরকে যা শেখানো হয় তারা তাই শেখে। প্রত্যেক শিশুর সহজাত প্রবৃত্তি কার্টুন দেখা। এক্ষেত্রে তাদের কাছে জাপানী কার্টুন ডরায়মন খুবই জনপ্রিয়। যদি এই কার্টুন বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় ডাবিং করে দেখানো সম্ভব হত তবে শিশুরা অবশ্যই সেটা দেখে বাংলা শিখতে পারত। কিন্তু সরকার তা না করে ডরায়মন কার্টুনটার সম্প্রচারই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। মাথাব্যাথার জন্য মাথাটাই কেঁটে ফেলে দেয়া হল আর কি! আগে ইউনিসেফের মীনা কার্টুন টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে দেখানো হত, যা শিশুদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল। তাছাড়া এই শিক্ষামূলক কার্টুনের মাধ্যমে শিশুদেরকে বিভিন্ন বিষয় সেখানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমানে কোন টেলিভিশন চ্যানেলেই মীনা দেখানো হয় না, যদিও হয়, তবে তা খুবই কম। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেকগুলো টিভি চ্যানেল রয়েছে, কিন্তু এর কোনটিতেই শিশুতোষ অনুষ্ঠান  সম্প্রচার করা হয় না। তাহলে শিশুরা কি শিখবে? বড় শহরগুলোতে শিশুদের খেলার জন্য মাঠ নেই, টিভিই তাদের কাছে বিনোদনের মাধ্যম, কিন্তু টিভিতে যদি শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক কোন অনুষ্ঠান না দেখানো হয় তবে শিশুরা টিভি দেখে কি শিখবে? সুস্থ্য সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে যদি শিশুদের সুশিক্ষা দেওয়া যায়, তবে এসব শিশুরাই দেশের সম্পদে পরিণত হবে। অপসংস্কৃতির প্রভাব আমাদের সমাজে কতটুকু তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। আমরা আসলে সঠিক শিক্ষার পরিবেশ তৈরী করতে পারছি না। এখন বেশীরভাগ শিশু-কিশোররা একটা ভালো গল্পের বই পড়ার পরিবর্তে সারাদিন ইন্টারনেট আর ফেসবুক নিয়ে মেতে থাকে। সারাদিন ফেসবুকে চ্যাটিং, মেসেজিং… এর জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে স্কুল-কলেজ আমার মত পড়ুয়াদের। আর এসবের সবচেয়ে খারাপ দিক, যে ছেলেটির ঘরে বসে পড়ালেখা করার কথা, সে মেয়েদের পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে !!! শিশুদের সুস্থ্য সংস্কৃতির চর্চার বিকাশ ঘটানো যায়, তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম দেশের সম্পদে পরিণত হবে। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। আগামী দিনটিকে সুন্দর করে তুলতে হলে প্রয়োজন শিশুদের সুশিক্ষা দেওয়া। আর শিশুদের সুশিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমেই আমরা আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে পারবো, পারবো আমাদের দেশের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করতে।

বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ছোট বেলা থেকেই ভর্তি করে দেয়া হয় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে । ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কোন সমস্যা নয় , সমস্যা গুলো তৈরি করছে স্কুল কতৃপক্ষ যারা স্কুলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু বাংলা যেটা আমাদের মাতৃভাষা এবং রাষ্ট্রীয় ভাষা সেই ভাষার দক্ষতার প্রতি তাদের কোন গুরুত্ব দিতে দেখছি না । ফলাফল কি হচ্ছে , আমার বাচ্চাটা ইংরেজিতে খুব ভালো কিন্তু বাংলাটা ধরতে পারছে না । অনেক অসুবিধা হয় তাকে বাংলা বুঝাতে , গেল বার পরীক্ষাতে বাংলায় সে খুবই খারাপ মার্কস পেয়েছে । পাবে না কেন ? তার জন্য সম্পূর্ণ ভাবে অভিভাবকেরাই দায়ী । একে তো সারাক্ষণ স্কুলে ইংরেজি চর্চা চলতে থাকে আবার বাসায় ফিরলেও বাবা মায়েরা তাদের উৎসাহিত করছে ইংরেজিতে কথা বলতে ।বাচ্চা কিছু বললে সেটা উত্তর আসছে ইংরেজিতে ,  বাচ্চাদের কিছু জিজ্ঞাসা করলে সেটা ও আসছে ইংরেজিতে । বাহ ! বাহ ! তাদের দেখলে মনে হয় কোন বৃটিশ পরিবার । অথচ যে সকল ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের নাম সারা বিশ্বে উজ্জ্বল করেছে তাদের মেধা ও প্রজ্ঞা দ্বারা , তারা কোন ইংরেজি মিডিয়ামের ছাত্র কিংবা ছাত্রী ছিলেন না । তারা সকলেই বাংলা মিডিয়ামেই পড়াশুনা করেছে । মনে রাখতে হবে ইংরেজি শুধুই একটি ভাষা , প্রতিভা প্রকাশের কোন মাধ্যম নয় । এটা জানাতে হবে শিশুদের , জানাতে হবে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বাহনকে , বাংলা ভাষাকে । আর এই চর্চাটা ছেলেবেলা থেকেই অভ্যাস করাতে হবে ।

ভাষা হচ্ছে একটি দেশের তাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহন । এই সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে একটি দেশের মর্যাদা ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশ ও বিদেশে । বাঙালি হিসাবে আমরা গর্বিত কারণ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে জীবনদানের ঘটনা একমাত্র আমাদেরই । বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা আদায়ে আমাদের অসংখ্য শহীদের রক্তে রাজ পথ রক্তিম হয়েছে । পৃথিবীর এমন কোন রাষ্ট্র নাই যারা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছে , রক্ত দিয়েছে । যে ইতিহাসের দাবিদার একমাত্র বাঙালি ও বাংলা ভাষা । সুতরাং এই ভাষাকে ঘিরেই আমাদের  সংস্কৃতি , আমাদের জীবনধারা । আমাদের এই সংগ্রামের কথা শিশুদের জানা উচিত , আমাদের এই উন্নত সংস্কৃতির কথা তাদের জানা উচিত । হ্যাঁ ,অভিভাবকেরাই পারেন এটা তাদের সামনে তুলে ধরতে । শিশুদের এটা জানাতে হবে যে, বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে বিশ্বের ১৪০টির ও বেশি দেশ । সেখানে আমরা বাংলাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে অক্ষম হলে সেই লজ্জা আমাদেরই ।

আমাদের সংস্কৃতি আমাদের নৃত্য , আমাদের আঞ্চলিক গান , আমাদের জাতীয় নাট্যশালা , চারুকলা ,শিল্পকলা একাডেমী , আমাদের জাতীয় শহীদ মিনার , ছায়ানট প্রভৃতি আমাদের  সংস্কৃতিকে লালন করছে এবং চর্চা করছে । বিশ্ব কবির নাম যে ভাষা ও সংস্কৃতিকে ঘিরে  সেটা বাংলা ভাষা ও রবীন্দ্র সঙ্গীত । আমাদের গর্বের আর একটি বড় জায়গা । শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে  নিজের সংস্কৃতিকে অবশ্যই জানতে হবে , চর্চা করতে হবে ও ধারন করতে হবে । পিতামাতা শিশুর হাত করে পহেলা বৈশাখের সকালে মঙ্গল শোভা যাত্রায় অংশ গ্রহন করবে , রমনার বটমূলে গিয়ে এসো হে বৈশাখ গান শুনবে , পান্তা ইলিশ খাবে ,তবেই তো শিশুটির মনে সংস্কৃতির স্থায়ী বিকাশ ঘটবে ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *