শৈশব ও কৈশোরের দুরন্তপনার দিনগুলো

তুষার আহমেদ : স্মৃতি হাতড়ে ফিরি। জীবন থেকে হারিয়ে গেছে শৈশব ও কৈশোরের দুরন্তপনার দিনগুলো।বিশেষ করে গ্রামের পথে হাটা, দল বেঁধে সাইকেলের টায়ার চালানো, খালের পানিতে মাছ শিকারের নামে সারাদিন পানিতে হই-হুল্লোড় করাসহ আরো কতো স্মৃতিই মনের দুয়ারে উঁকি দেয়। যে দিন গুলো ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
শহুরে জীবনে তো পাওয়াই হয়না মজার সে দুষ্টমির স্থান ও সময়। সকাল হতে না হতেই স্কুলের ব্যগ নিয়ে পিচ ঢালা পথ পাড়ি দিতে হয় শৈশবেই। যান্ত্রিক সব শব্দের ভিড়ে কখন যে শেষ হয়ে যায় সময়গুলো বুঝতেই পারা যায় না।
এমন কিছু ছবি নিয়েই তুলে ধরছি শৈশব আর কৈশোরের ফেলে আসা কিছু চিত্র।
একাকী রৌদ্রময় দিনে বাড়ির পাশের সবুজ ক্ষেতে আর ঘুড়ি উড়ানো হয়না। ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে মায়ের বকাঝকা খেয়ে অভিমানে করা হয় না কান্না।

পকেটে মার্বেল নিয়ে স্কুলে যাওয়া এবং সুযোগ পেলেই খেলা। বাড়ি ফিরেই আবারও বেড়িয়ে পড়া ভর দুপুর কিংবা বিকেল। কখনো দু’জন আবার কখনো কয়েকজন মিলে সে এক অন্যরকম ভালো লাগার খেলায় মত্ত থাকা।
ফেলে দেয়া বেয়ারিং দিয়ে বানানো গাড়ীটি চালাতে কতো দিনই স্কুল ফাকি দেয়া হয়েছে। এ কাজের জন্য মায়ের হাতের পিটুনিরও কি হিসেব করে শেষ করা যাবে?

বৃষ্টি কিংবা রৌদ্র কোন কিছুরই তোয়াক্কা না করে বড়শি হাতে বেড়িয়ে পড়া মাছ ধরার নেশায়। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে নির্ভেজাল আনন্দ পেতে ছুটে চলা দিনের পর দিন।
মাঠের এ কোনায় একটিই গাছ। দাদা চলে আসার আগেই উঠতে হবে, বসতেও হবে পছন্দসই জায়গায়, তাই তো চলছে প্রতিযোগিতা, কে আগে উঠবে। কোন হিংসা নেই বলে সহযোগীতা করা হচ্ছে একে অপরকে। এই দিনকি আর আসবে?

এমন মোরগ যুদ্ধ শেষে আপ্রাণ চেষ্টা থাকে মোরগগুলো ধরার এতো অনাবিল এক আনন্দ ।
টানাটানি খেলার নামে ফেলে আসা গোধুলী বিকেলগুলো মনের কোনায় উকি মারে। সে দিন ফিরে আসবেনা তাই কষ্টের জায়গাগুলো প্রসারিত হয়।

মাছ পা্ওয়ার আশায় দল বেধে কখনো জাল, আবার কখনো কাপড় দিয়েও এভাবে কাঁদামাটি মেখে মাছ ধরার চেষ্টা থাকত অবিরত। হয়তো সামান্য কিছু মাছ পাওয়া গেলেও আনন্দটা থাকত নির্মল।
কারো আছে কারো নেই, তাতে কি, একবার তুই একবার আমি এভাবেই দৌড়িয়ে চলা সময়ে আশপাশের কোন কিছুই মোহিত করতে পারেনি। সুনির্দিষ্ট  সীমানা পাড়ি দেয়া ছাড়া।

খড়ের স্তুপে দলবেধে এভাবেই অকারণ হাসি-তামাশার আড্ডায় কেটে যেত কিছুটা সময়। এখানেও খুঁজে নিত সকলে আনন্দের উৎস।
ভাঙ্গা একটি ব্রীজ, অথচ সে সময় আনন্দ দেবার জন্য এটিই ছিল অনেক বড় উপকরণ। অনেকক্ষণ খেলে চোখ লাল করে বাড়ী ফিরলে মায়ের মুখের সচারাচর বকাঝকা ছিল নিয়মের মধ্যে একটি।

নির্ভুল লক্ষ্যভেদে গুলতির জুড়ি মেলা ভার। এ নিয়ে প্রায়শই লেগে থাকত প্রতিযোগিতা। কে কতটা পারঙ্গম তার পরীক্ষা চলত হরদম। কখনোবা গাছ থেকে আম, সুপারি, খেজুর, বড়ই ইত্যাদি পেড়ে খাওয়া হতো এই বিশেষ যন্ত্র দিয়ে।
পানিযুক্ত ফসলের মাঠ এটাও ছিল খেলার স্বর্গরাজ্য। নিজেদের ইচ্ছেমত খেলা। খেলা শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ী ফেরা। গোল হোক বা না হোক বলটা শুধু আমার কাছে থাকলেই হল। এমনটা্ই ছিল মনোভাব।

শীত এলেই পাড়ার ছেলে-মেয়েরা এভাবে খড়কুটো পুড়িয়ে আগুন পোহানো ছিল দারুন মজার ব্যাপার। কখনো এই আগুনেই দেশী আলু অথবা মিষ্টি আলু পুড়ে খাওয়া হতো। সে ছিল অন্যরকম এক মজাদার ব্যাপার।
বর্ষার নতুন পানিতে নদী কিংবা পুকুরে সাতার না কাটলে কি হয়। পানি হোক অল্প কিংবা বেশি সাতার কিন্তু কাটতেই হবে।  তাই দাড়িয়ে কিংবা সাতরিয়ে যেভাবেই হোক পানির স্বাদটা নিতেই হবে।

এক পা এভাবে ধরে চলতো মোরগ যুদ্ধ খেলা। এভাবে কে কারে ফেলে দিতে পারে তারই চলতো প্রতিযোগিতা। কখনো পাড়ায় কিংবা কখনো স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে এ খেলার আনন্দে মাতোয়ারা থাকতো সকলেই।
নদীতে ভেঙ্গে যাচ্ছে গ্রামের অনেক ঘর বাড়ি, তাতে কী, নদীর পারে দাড়িয়ে মজা করা থেকে কি বিরত থাকা যায়? কেউ তো আবার তাকিয়ে থাকে অভিভাবকদের কে যায় এমন সময়ে।

কয়েকজন একসাথে হলেই হাডুডু খেলায় মেতে উঠা। এজন্য নির্দিষ্ট সময় কিংবা কোন স্থান লাগত না। থাকত হারজিতের ব্যাপার। গায়ে মাটি মেখে আনন্দ পেতো খেলায় অংশগ্রহণকারীরা তো বটেই, সাথে দর্শকরাও কম যেতো না।
যে ভাবেই হোক ধরতে হবে, একা তো আর পারা সম্ভব না, তাই সবাই মিলে চলছে প্রচেষ্টা, কিভাবে বশ্ করা যায় এই সুন্দর হাঁসগুলোকে। যারই হোক ধরতেই হবে, কারণ আমরা এখন শিকারী।

কখনো মাটিতে, কখনো হাতের তালুতে ঘোরানো লাটিম খেলা একটুতেই জমে উঠত। কেউ পিছিয়ে থাকার নয়। খেলায় অংশগ্রহণকারী কিংবা দর্শক সবার মধ্যেই থাকতো টান টান উত্তেজনা।
এ খেলা আর দেখা হয় না। চাইলেই পরা হয়না লাল ধুতি। ভাঙ্গা গলায় গাওয়া হয়না এবড়ো-থেবড়ো গান।
এ রকম অনেক খেলা রয়েছে যেগুলো গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। যারা গ্রামে থেকে বড় হয়েছেন তাদের কাছে মনে হবে এইতো সেদিনও ওদের সাথে ছিলাম। কিন্তু এখন আর সেভাবে সময় কাটানো যায়না। চাইলেই মায়ের কাছে কিংবা বাড়ীর পাশে ধানের ক্ষেতে আপন মনে ছুটে চলা হয়না। আকাশের তারাদের মত অনেক দুরে চলে গেছে সে দিন গুলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *