শিশুদের জন্য চাই সুন্দর ও সুস্থ সংস্কৃতি
মোসাম্মৎ সেলিনা হোসেন : এই সুন্দর পৃথিবীটাকে আগামী প্রজন্মের মানুষদের জন্য বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে প্রথমেই নিশ্চিত করা প্রয়োজন শিশুদের জন্য সুন্দর ও সুস্থ সংস্কৃতি।
মহান আল্লাহ তায়ালার অবাক ও বিস্ময়কর সৃষ্টি এই বিশাল পৃথিবী। এই বিশাল পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কোটি কোটি বিস্ময়, রয়েছে জানা অজানা কোটি বিষ্ময়কর উপাদান। তেমনি মানুষের চারপাশে অনেক বিস্ময় ছড়িয়ে আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে শিশুরা।
শিশুদের নিয়ে প্রায় সবাই তাদের ভাবনা, উপলব্ধি প্রকাশ করে আসছেন প্রাচীনকাল থেকে। আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই সাহিত্যে, মনোবিজ্ঞানে, শিল্পে। অথচ শিশু সম্পর্কে মানুষের আবেগ যতটুকু, দায়িত্ববোধ আসলে ততটুকু গভীর নয়। শিশুর অন্তরে ঘুমিয়ে থাকা একজন শিশুর পিতাকে মানুষ প্রত্যাশা করে, কিন্তু সেই ভবিষ্যত শিশুর পিতাকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সঠিক দায়িত্ববোধ আমাদের মধ্যে নেই। একটি শিশুকে পরিচর্যা করতে হয় বাগানের গোলাপ গাছের মত। শুধুমাত্র সঠিক পরিচর্যা করতে পারলেই সেই শিশু একদিন একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে, সমাজের জন্য ভূমিকা রাখে।
একটি শিশুকে ছোটবেলা থেকে যা শিক্ষা দেওয়া হয় সে সেভাবেই গড়ে উঠে। একটা শিশু বড় হয়ে কি হবে তা আসলে নির্ভর করে তার অভিজ্ঞতার জগতের উপর, আর তার অভিজ্ঞতার জগত সমৃদ্ধ হওয়া নির্ভর করে তার চারপাশের পরিবেশের উপর। প্রতিদিনই সে যতবড় হতে থাকে তার অভিজ্ঞতা ততই বাড়তে থাকে।
আমরা আমাদের সমাজে নানা ধরনের অনাচার, অসঙ্গতি লক্ষ করছি। এর জন্য দায়ী আসলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। শিশুদেরকে সুশিক্ষা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শিশুর জন্য বাবা-মার আদর আছে, ভালোবাসা আছে। কিন্তু আসলে আমাদের সমাজে সুশিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে। শিশুর বিকাশের ধারা, তার বড় হয়ে উঠার প্রক্রিয়া বুঝা উচিত। দেহের গঠনে বড় হওয়া নয়, মানসিক গঠনে বড় হওয়ার ব্যপারে লক্ষ রাখা উচিত। একটা শিশুকে সামাজিকীকরণ করার জন্য প্রধান ভূমিকা রাখে তার পরিবার, পরিবার থেকেই শিশুরা নৈতিক আচার-ব্যবহার শিক্ষা পেয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের সমাজে এই সামাজিকীকরণের উপাদানগুলোতে ঘাটতি রয়েছে, যার জন্য একটি শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা দুঃসহ হয়ে পড়ছে।
সুশিক্ষা বলতে শুধু স্কুল-কলেজের পুঁথিগত বিদ্যা নয়, সুশিক্ষা আসলে নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষার অভাবের কারণেই আমাদের সমাজে নানা ধরনের সমস্যা, অসঙ্গতি সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমান যুগকে বলা হচ্ছে নৈতিকতা অবক্ষয়ের যুগ, আর এই নৈতিকতা অবক্ষয়ের কারণে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা দায়ী। আর নৈতিকতা অবক্ষয়ের কারণ বিভিন্ন অপসংস্কৃতির প্রভাব । এজন্য আমাদের সমাজে আজ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত।
শিশুরা যদি সুস্থ্য সংস্কৃতির চর্চা করে, তবে অবশ্যই সেটা তার সঠিক মেধাবিকাশে কাজে লাগবে। সঠিক মেধাবিকাশের মাধ্যমেই একটা শিশু ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে।
দিন দিন সুস্থ্য সংস্কৃতির চর্চা কমে যাচ্ছে। আমরা বিভিন্ন অপসংস্কৃতির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছি। যা শিশুদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। টিভি খুললেই দেখা যায় ভারতীয় চ্যানেলের ছড়াছড়ি। এসব ভারতীয় অপসংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়ছে। ইদানীংকালের একটি আলোচিত সামাজিক সমস্যা-ইভ টিজিং, যা আসলে এসব অপসংস্কৃতির প্রভাব।
ডোরিমন নামের একটি জাপানী কার্টুন বাংলাদেশে হিন্দী ভাষায় সম্প্রচার করা হয়, অনেক ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বাসায় বসে টিভিতে ডোরিমন দেখছে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে বেশীরভাগ শিশুরাই বাংলার চাইতে হিন্দিতে কথা বলতে বেশি পছন্দ করে। অর্থাৎ আমরা বিদেশী সংস্কৃতির প্রতি বেশী ঝুঁকে পড়ছি, যা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
শিশুদেরকে যা শেখানো হয় তারা তাই শেখে। প্রত্যেক শিশুর সহজাত প্রবৃত্তি কার্টুন দেখা। এক্ষেত্রে তাদের কাছে জাপানী কার্টুন ডোরিমন খুবই জনপ্রিয়। যদি এই কার্টুন বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় ডাবিং করে দেখানো সম্ভব হত তবে শিশুরা অবশ্যই সেটা দেখে বাংলা শিখতে পারত। কিন্তু সরকার তা না করে ডোরিমন কার্টুনটির সম্প্রচারই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। মাথাব্যাথার জন্য মাথাটাই কেঁটে ফেলে দেয়া হল আর কি!
আগে ইউনিসেফের মীনা কার্টুন টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে দেখানো হত, যা শিশুদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল। তাছাড়া এই শিক্ষামূলক কার্টুনের মাধ্যমে শিশুদেরকে বিভিন্ন বিষয় সেখানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমানে কোন টেলিভিশন চ্যানেলেই মীনা দেখানো হয় না, যদিও হয়, তবে তা খুবই কম। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেকগুলো টিভি চ্যানেল রয়েছে, কিন্তু এর কোনটিতেই শিশুতোষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয় না। তাহলে শিশুরা কি শিখবে? বড় শহরগুলোতে শিশুদেও খেলার জন্য মাঠ নেই, টিভিই তাদের কাছে বিনোদনের মাধ্যম, কিন্তু টিভিতে যদি শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক কোন অনুষ্ঠান না দেখানো হয় তবে শিশুরা টিভি দেখে কি শিখবে? সুস্থ্য সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে যদি শিশুদের সুশিক্ষা দেওয়া যায়, তবে এসব শিশুরাই দেশের সম্পদে পরিণত হবে। আর যদি তা করা না যায়, তবে আমরা জাতিগতভাবে ধ্বংসের মুখে পড়ব।
অপসংস্কৃতির প্রভাব আমাদের সমাজে কতটুকু তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। আমরা আসলে সঠিক শিক্ষার পরিবেশ তৈরী করতে পারছি না।
এখন বেশীরভাগ শিশু-কিশোররা একটা ভালো গল্পের বই পড়ার পরিবর্তে সারাদিন ইন্টারনেট আর ফেসবুক নিয়ে মেতে থাকে। সারাদিন ফেসবুকে চ্যাটিং, মেসেজিং ইত্যাদির জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা। ইন্টারনেটকে লেখাপড়ার কাজে ব্যবহার করা যায়, কিন্তু ছেলে-মেয়েরা এর হাজার-হাজার সুফলকে বেছে না নিয়ে বেছে নিচ্ছে এর খারাপ দিকটাই। কারও ক্ষেত্রে তা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। এসব জিনিস আমাদের শিশু-কিশোরদের মধ্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ইভ-টিজিং সহ নানাভাবে নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য ইন্টারনেটের কুফল অনেকাংশেই দায়ী। ইন্টারনেট এখন সহজলভ্য হয়ে পড়ায় এসব সমস্যা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। সরকার ইন্টারনেট ব্যবহারে বিভিন্ন আইন করলেও তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না।
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, বিভিন্ন অপসংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিশু-কিশোরদের ওপর। আর আমাদের ভবিষ্যতটাও দিন-দিন অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। অনিশ্চয়তার অন্ধকার গ্রাস করেছে পুরো সমাজকেই।
বর্তমান প্রজন্ম ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দিবে এটাই সকলের কাম্য। এই প্রজন্মকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হলে দ্রুত এসব অপসংস্কৃতির প্রভাব দূর করতে হবে। তা না হলে নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে আমাদেরকে আরও বড় কোন মূল্য দিতে হতে পারে। তাই সময় থাকতেই সরকার এবং দেশের সকল সুনাগরিককে সতর্ক ও সাবধান হতে হবে।
শিশুদের সুস্থ্য সংস্কৃতির চর্চার বিকাশ ঘটানো যায়, তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম দেশের সম্পদে পরিণত হবে। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। আগামী দিনটিকে সুন্দর করে তুলতে হলে প্রয়োজন শিশুদের সুশিক্ষা দেওয়া। আর শিশুদের সুশিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমেই আমরা আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে পারবো, পারবো আমাদের দেশের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করতে। শিশুদেরকে সুশিক্ষা দেওয়া গেলেই আমরা আমাদের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে পারবো।
তাই সুশীল সমাজের প্রতি আহ্বান, শিশুদের প্রতি নজর দিন, শিশুদের সুশিক্ষা দেওয়ার ব্যপারে নজর দিন। সকল শিশুর সুশিক্ষা গ্রহণ করার পরিবেশ তৈরি করুন, তাহলেই সম্ভব হবে দেশকে এগিয়ে নেয়া। কারণ, “শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত”।