কিশোর বাংলা প্রতিবেদন: সমাজে বেড়ে গেছে কিশোর অপরাধ। যে বয়সে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, মাঠে খেলার কথা, সেই বয়সের কিশোররা এখন ছুরি–চাকু এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাস্তানি করে, মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। মেয়েদের দিকে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে, শিস বাজায়। বাধা দিলে রক্তারক্তি, খুনাখুনি করে।
এই কিশোর খুনি বা অপরাধীদের মধ্যে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বস্তির বাসিন্দা কিশোররাও। কিশোর অপরাধ নিয়ে পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। কিশোর অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
কিশোরদের এভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার কারণ কী? এর জন্য মূল্যবোধের অবক্ষয়কেই দায়ী করা হয়। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, দুর্বল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষার অভাবই এর জন্য দায়ী। সন্তানের শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের প্রতি অভিভাবকদের যতটা মনোযোগ দেয়া দরকার, প্রায় তা দেয়া হয় না। সন্তান যা চায়, তাই দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করতে চায়। চালকের লাইসেন্স না থাকলেও তার হাতে গাড়ির চাবি তুলে দেয়া হয়। মোটরসাইকেল কিনে দেয়া হয়। এরা রাস্তায় রীতিমতো ত্রাসের সৃষ্টি করে। দুর্ঘটনাও ঘটায়। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। কিন্তু সেই অভিভাবকরা সন্তানের কোনো অপরাধই দেখতে পান না। মাদক বিক্রেতা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ পর্যন্ত অনেকেই নিজের সামান্য লাভের জন্য কিশোরদের অপরাধ জগতে টেনে নেন। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করেন। গডফাদারদের কেনা মানুষ হয়ে যায় তারা। ফলে একসময় এই কিশোররা পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এরা হয়ে ওঠে নেশাগ্রস্ত ও সম্পূর্ণরূপে একেকজন অপরাধী। তখন শুধু পাড়া পড়শির নয়, নিজের পরিবারের জন্যও তারা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
রাজধানীসহ সারাদেশে ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। বিভিন্ন গবেষণায় এদের বেশির ভাগ বয়স ১৪ থেকে ১৬ বছর। তাদের অনেকে মাদকাসক্তও। মাদকের টাকা জোগাড় করতে ছিনতাইয়ের মতো অপরাধেও জড়াচ্ছে তারা। এমনকি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে পড়ছে নৃশংস খুনাখুনিতে। কিশোরদের এই পরিণতির জন্য মা–বাবার উদাসীনতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, সামাজিক মূল্যবোধহীন এই সমাজে বেড়ে ওঠা এসব কিশোর ক্রমেই যেমন অস্থির হয়ে উঠছে, তেমনি পরিবারের অজান্তেই হয়ে উঠছে ভয়স্কর সস্ত্রাসী। গড়ে তুলছে নিজস্ব গ্রুপ। অধিপত্য বিস্তারে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের ওপর হামলা চালাচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় উঠতি এসব কিশোর সন্ত্রাসীর উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নাগরিক জীবনও। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু প্রচলিত অপরাধ জগতের সাথেই নয়, সমাজের উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেক কিশোর সঙ্গদোষে অথবা অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে এমন সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, যা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়।
দেশের দুই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সেখানে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলার আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামী। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশির ভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে আসা এসব কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও। তাদের অনেকে মাদকাসক্তও হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ৯ থেকে অনুর্ধ্ব ১৮ বছরের কোনো ছেলেশিশু অপরাধে জড়ালে তাদের গাজীপুরের টঙ্গী ও যশোরের পুলেরহাটের কিশোর (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়। এ দুটি কেন্দ্র থেকে সমাজসেবা অধিদফতরের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য পাঠানো হয় গত ৩১ ডিসেম্বর। ওই দিন কেন্দ্র দুটিতে ছিল ৫৯৭ কিশোর। তাদের মধ্যে ১২০জন হত্যা মামলার আসামি। ১৪২ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলা এবং ৯ জন তথ্যপ্রযুক্তি ও পর্নোগ্রাফি আইনে করা মামলার আসামি। এর বাইরে চুরির মামলায় ৮৯, ডাকাতি ১৬, ছিনতাই ৬, মাদক মামলায় আছে ৫ জন। অন্যরা সাধারণ ডায়রিসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। এ ছাড়া গাজীপুরের কোনাবাড়িতে নির্মিত কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রটি মেয়েদের জন্য। অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন আর্থ–সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বা তথ্যপ্রযুক্তি কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ।
কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের আচরণে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে জানিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এরা পাড়ার মোড়ে মোড়ে দল বেঁধে আড্ডা দেয়, মেয়েদের ইভটিজিং করছে। বড়দের সামনে প্রকাশ্যেই একের পর এক সিগারেট ফোঁকে। বখে যাওয়া এসব সন্তান কখন কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, তার বেশির ভাগ খবরই রাখেন না তাদের অভিভাবকরা। কিশোর বয়সে দামি ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, রাত জেগে মোবাইল ফোনে কথা বলা এবং নতুন নতুন বন্ধু তৈরির সাথে ধীরে ধীরে অসৎ সঙ্গে মিশে যাওয়াকে দায়ী করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা।
বাবা–মায়ের অসচেতনতা এবং সময় না দেওয়ার কারণেই শিশু–কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। শিশু বয়সেই দামি ফোন কিনে দেওয়ার ফলে প্রযুক্তি থেকে ভালো শিক্ষার পরিবর্তে খারাপ শিক্ষা নিচ্ছে। বিভিন্ন পর্নোসাইডে প্রবেশসহ সারাবিশ্ব জানতে গিয়ে নিজের অজান্তেই অন্ধকার জগতে পা বাড়াচ্ছে। এদের মধ্যে উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেক সন্তানও রয়েছে। নেশার টাকা জোগাড় করতেই এসব কিশোর অপরাধে জড়াচ্ছে। টিনএজ বা কম বয়সের অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে।
আমরা একথা জানি যে, প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো পিছিয়ে আছে। প্রযুক্তির আবিষ্কার ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে উন্নত দেশগুলো। আমাদের দেশেও এখন ঐসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের ইতিবাচক দিকগুলো তো স্পষ্ট, তবে এর নেতিবাচক দিকগুলোর ব্যাপকতা ও মাত্রা কেমন তাও আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। নইলে হিতে বিপরীতের আশঙ্কাই বাস্তব বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এখন তো বলা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের অসামাজিক করে তুলেছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার ও সময়ের অপচয়ের অভিযোগ তো আছেই। আর স্মার্টফোন তো এখন পরিবার ও সমাজের জন্য অনেকক্ষেত্রে আপদের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজনের কথা বলে কিশোর– কিশোরী ও তরুণ– তরুণীরা অভিভাবকের কাছে স্মার্টফোনের আবদার করে থাকেন। অভিভাবকরাও মমতার বশবর্তী হয়ে সন্তানদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন।
সমাজ পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর পেছনে একক কোনো কারণ নেই। এর সঙ্গে দুষ্ট বন্ধুদের প্রভাব, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, শিশুদের সঠিক পরিচর্যার অভাব, মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়া, স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেটের অপব্যবহারসহ বেশ কিছু কারণ রয়েছে। আবার অনেক মা–বাবা আছেন, সন্তান কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে, ইন্টারনেটে কী দেখছে সে সম্পর্কে তাঁরা খোঁজখবর রাখেন না। ফলে সন্তান যে বিপথগামী হচ্ছে, সেটা তাঁরা শুরুতে টের পান না।
অনেক পরিবারের বাবা মা মনে করেন টাকা দিলেই সব দায়িত্ব শেষ। যাঁরা এমন মনে করেন, তাঁদের সন্তানদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপক ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতাও শিশু কিশোরীদের অপরাধী করে তুলছে। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, স্মার্টফোনের সদ্ব্যবহার কতোটা হয়? স্মার্টফোন তো কৌতূহলী কিশোর–কিশোরী ও তরুণ–তরুণীদের সামনে যেন নতুন এক রঙিন পৃথিবী উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এই ফোনের মাধ্যমে যেমন জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হওয়া যায়, তেমনি পরিচিত হওয়া যায় নিষিদ্ধ জগতের সাথেও। যৌনতা ও পর্নোগ্রাফি এক জনপ্রিয় বিষয় হলে উঠেছে। আর বিনোদনের তো কোনো সীমা পরিসীমা নেই। গান–বাদ্য, ছায়াছবি এখন সহজলভ্য হয়ে উঠেছে স্মার্টফোনের বদৌলতে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ২৪ ঘন্টাব্যাপী অবারিত এতো সব রঙিন বিষয় ও বিনোদন পন্য মানব স্বাস্থ্যের জন্য কতোটা ইতিবাচক? মানুষকে তো কাজ করে খেতে হয়। স্বাভাবিক মানুষ কাজের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নিতে চায়। ২৪ ঘন্টার জীবনে পেশা, খাওয়া, ঘুম ছাড়াও মানুষকে পারিবারিক ও সামাজিক নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। এর মধ্যে স্বাভাবিক ও সুস্থ মানুষ তো বিনোদনের জন্য দুই এক ঘন্টার বেশি বরাদ্দ করতে পারেন না। কিন্তু হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন থাকায় তার একটা প্রলোভন বা আকর্ষণ তো থাকেই। ফলে অনেক সময় মানুষ শৃঙ্খলায় থাকতে পারে না। সময়ের অপচয় হয়, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও দেখা দেয় সমস্যা। ফলে প্রযুক্তির ব্যবহার এখন চিন্তুাশীল মানুষদের কাছে এক বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিশোরদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে না পারলে আমরা উন্নত রাষ্ট্র গড়ব কিভাবে? অবিলম্বে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হোক। বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করলেই মানবজাতির মঙ্গল।