ফিলিস্তিনি শিশুদের এক কঠিন পথচলা

কিশোর বাংলা প্রতিবেদনঃ ফিলিস্তিনি শিশুরাও অন্য সব দেশের শিশুদের মতই। তারাও ভালবাসে খেলাধূলায় মেতে থাকতে। কিন্তু ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন হয় না সবসময়। এক কঠিন জীবন প্রতি পদে অপেক্ষা করে তাদের জন্য।

জেরুজালেম, ১৩ মে- সেদিন বেথলেহেম আর হেবরনের মধ্যে পশ্চিমতীরের বাইত উম্মার গ্রামে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা পড়েছিল। কিন্তু, আবহাওয়ার কারণে আবু-আয়াশ পরিবারের বাচ্চাদের ঘরের বাইরে এসে খেলা থামাতে পারেনি।

এদের একজন স্পাইডারম্যানের কস্টিউম পরে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ তারা রাস্তা ধরে আসতে দেখে ইসরাইলি সৈন্যদের। মুহূর্তে তাদের তাদের মনের অবস্থা আনন্দ থেকে ত্রাসে বদলে যায়, হুড়মুড় করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায় তারা।

বাচ্চাদের এমন প্রতিক্রিয়া নতুন কিছু নয়, জানান তাদের বাবা। ১০ বছর বয়সী ওমরকে ইসরাইলি সৈন্যরা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই বাচ্চারা এ রকম আচরণ করে আসছে।

ওমর সেই সব শত শত শিশুর একজন, যাদের ইসরাইল প্রতি বছর গ্রেফতার করে বন্দি করে রাখে। ইসরাইলের সবচেয়ে পুরনো পত্রিকা হারেটজে গত ২৬ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরাইল ৮০০ থেকে ১ হাজার ফিলিস্তিনি শিশুকে এভাবে বন্দি করে রেখেছে। এদের অনেকের বয়স ১৫ বছরের নিচে; কারও কারও বয়স ১২-১৩ বছরেরও কম।

ফিলিস্তিনিদের আঁকা একটি ম্যাপ থেকে জানা যায়, ফিলিস্তিনিদের একটি গ্রাম ইসরাইলি বসতির যত কাছে থাকে সেখানকার শিশুদের ইসরাইলি বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা হয়, কার্নেই শমরন বসতির পশ্চিমে অবস্থিত আজ্জুন টাউনে এমন কোনো বাড়ি নেই, যেখান থেকে কাউকে না কাউকে গ্রেফতার করেনি দখলদার ইহিুদি সেনা।

স্থানীয় বাসিন্দারা হারেটজকে জানান, গত পাঁচ বছরে ওই টাউনের একমাত্র হাইগ স্কুলের ১৫০ জনেরও বেশি ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ফিলিস্তিনিপত্রিকাটি জানায়, ইসরাইলি কারাগারগুলোতে সব সময় কমবেশি ২৭০ জন ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোর বন্দি থাকে। এদের বন্দি করার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হিসেবে পাথর ছুঁড়ে মারাকে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু, এতে পুরো গল্পটা জানা যায় না।

অনেক শিশু-কিশোর, তাদের আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী এবং বিতসেলেমের মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে কথা বলে একটা গ্রেফতারের বিশেষ প্যাটার্ন ফুটে ওঠে। কিন্তু তাতেও সব কিছু পষ্ট হয় না। যেমন: দখল করার প্রক্রিয়া এতটা সহিংস হতে হবে কেন এবং এজন্য শিশুদের হুমকি দেয়া জরুরি কেন, তা বুঝা যায় না।

ফিলিস্তিনি শিশুদের গ্রেফতার করায় অনেক ইসরাইলির অনুভূতিতে আঘাত লাগায় তারা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন এবং এর বিরুদ্ধে কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানায় হারেটজ।

‘প্যারেন্টস এগেইন্সট চাইল্ড ডিটেনশন’ নামের একটি সংগঠন সোচ্চার হয়ে উঠেছে এই কর্মসূচিতে। সংগঠনটির প্রায় ১০০ কর্মী সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয়। তারা ফিলিস্তিনি শিশুদের অধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে এবং এ রকম গ্রেফতার বন্ধে চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে জনসমক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করে যাচ্ছে।

সংগঠনটি ইসরাইলি বাবা-মাকে লক্ষ্য করে প্রচারণা চালাচ্ছে যেন তারা শিশুদের বন্দি করে রাখার খবরে সহানুভূতিশীল হয়ে পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

সাধারণভাবে এ রকম গ্রেফতারের সমালোচনার কোনো কমতি নেই। বিতসেলেম এসব ঘটনা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখে। এ ছাড়া বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে।

২০১৩ সালে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ, ‘সামরিক বন্দি রাখার ব্যবস্থায় শিশুদের দুরবস্থার’ সমালোচনা করেছে।

এর এক বছর আগে ব্রিটিশ আইনজীবীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বন্দি ফিলিস্তিনি শিশুদের অবস্থা নির্যাতনের শামিল। মাত্র পাঁচ মাস আগে পার্লামেন্টারি অ্যাসেম্বলি অফ দ্য কাউন্সিল অফ ইউরোপ শিশুদের গ্রেফতার করতে ইসরাইলের কৌশলের সমালোচনা করে বলে, ‘গ্রেফতার, পরিবহন, অপেক্ষা এবং জিজ্ঞাসাবাদের সময় শিশুদের ওপর মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।’

গ্রেফতার ফিলিস্তিনি শিশুদের অর্ধেককেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের বাড়ি থেকে। ইসরাইলের সৈন্যরা সাধারণত মধ্যরাতে তাদের বাড়িতে অতর্কিতে ঢুকে ধরে নিয়ে যায়। এদের পরিবারের কাছে দেয়া হয় একটা কাগজ যেখানে এদের গ্রেফতারের কারণ ও কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা উল্লেখ থাকে। ওই দলিল আরবি ও হিব্রুতে ছাপানো হলেও সৈন্যরা সাধারণত এর বিশদ তথ্য কেবল হিব্রুতে পূরণ করে।

আটক শিশুদের বাবা-মা এটা পড়তে পারেন না এবং তাদের বাচ্চাদের কেন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা জানতেও পারেন না।

ডেকে নিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদের বদলে শিশুদের এভাবে গ্রেফতার করা কেন জরুরি তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অ্যাটর্নি ফারাহ বায়াদসি।

‘আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হলে সে যায়,’ বলেন তিনি।

বায়াদসি আন্তর্জাতিক এনজিও ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনালের আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন। শিশুদের গ্রেফতার ও তাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে সংগঠনটি।

আইন অনুযায়ী শিশুদের হাত সামনে রেখে তাদের হাতকড়া পরানোর কথা। কিন্তু, সৈন্যরা অনেক ক্ষেত্রেই এদের হাত পিছমোড়া করে হাতকড়া পরায়। অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চাদের হাত এত ছোট হয় যে হাতকড়া লাগানো যায় না, ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স নামের একটি এনজিওকে বলেন নাহাল ইনফ্যান্ট্রির একজন ইসরাইলি সৈন্য।

এরপর শুরু হয় তাদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। আর্মি বা পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার সময় ফিলিস্তিনি বাচ্চাদের চোখ বেঁধে রাখা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের আগে অযথাই ঘোরানো হয় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। বন্দি করার আগে অনেক সময় তাদের ফেলে রাখা হয় খোলা স্থানে।

‘চোখ ঢাকা থাকলে কল্পনায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সব জায়গার কথা মনে আসে,’ হারেটজকে বলেন ফিলিস্তিনি শিশুদের হয়ে কাজ করা এক আইনজীবী।

আর্মির ঘাঁটি বা পুলিশ স্টেশনে পৌঁছলে হাতকড়া পরা এবং চোখ বাঁধা অবস্থায় শিশুটিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেলে রাখা হয় চেয়ারে বা মাটিতে। এ সময় সাধারণত তাদের কিছুই খেতে দেয়া হয় না।

বায়াদসি এই প্রক্রিয়াকে ‘নরকের পানে নিরন্তর যাত্রা’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘ছাড়া পাওয়ার পর বহু বছর ওই ছেলের এই ঘটনার অভিজ্ঞতা মনে থাকে। এতে তার মনে একটা স্থায়ী নিরাপত্তাহীনতা গেঁথে যায়, যেটা সারা জীবন তার মনে থাকে।’