নিস্তব্ধ ইউশার বাকরুদ্ধ স্মৃতি
নিস্তব্ধ ইউশার বাকরুদ্ধ স্মৃতি
তুষার আব্দুল্লাহ
সাজ্জাদ, পেশায় একজন সাংবাদিক । বাবাকে হারিয়ে অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরেছেন । জীবন থেমে নেই । মা, স্ত্রী, এক ভাই ও এক বোন কে নিয়ে তার সংসার । বেশ সুখেই কাটছে দিনগুলো । এ সুখের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে তার কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় এক ছেলে সন্তান । নবীর নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখেন ইউশা । কর্মময় জীবনে বাড়ে ব্যস্ততা । ধরা দেয় সুখ সমৃদ্ধি । হয়তো এই শিশুই নিয়ে আসে সুখের আগমনী বার্তা । যাকে ঘিরে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আগ্রহ উদ্দীপনার শেষ নেই । এমনি করে কেটে যায় কয়েকটি বছর ।
ইউশার বয়স এখন পাঁচ বছর । তার ৫ম জন্মদিনের আমেজ দেখেই বুঝা যায়, চিশতি সাহেব তার বাবা হারানোর শোক কিছুটা হলেও ভুলতে পেরেছেন । ইউশার চাচা ও ফুপু দুজনেই এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন । চারপাশে শুধু আনন্দের বন্যা । ঈশ্বর তার দু হাত খুলে দান করেছেন, একটুও কার্পণ্য করেননি ।
এদিকে ইউশার আদরের অভাব হয় না । কখনো ফুপু, কখনো চাচু, আবার কখনো দাদী কে নিয়ে আনন্দে মেতে থাকতো। ইউশা এখন টিপটিপ পায়ে স্কুলে যায় । স্কুলে তার বন্ধু বান্ধবের অভাব হয় না । ছোট বড় সবার সাথে সহজেই মিশতে পারে সে । আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা যেন এই ছেলেটি জন্ম থেকেই পেয়েছে । মা – দাদীর হাজার বারণ থাকা সত্বেও সে স্কুলের বন্ধুদের সাথে তার টিফিন ভাগাভাগি করে খায় । পরীক্ষার হলে সবাইকে সাহায্য করে । এ সকল কর্মকান্ডের জন্য মায়ের কাছে বকুনি শুনেছে অনেক । তাতেও তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । সে শুধু খিল খিল করে হাসে । যে হাসিতে রয়েছে অপরের জন্য ভালবাসা ।
তার অসাধারন মেধার জন্য অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে স্কুলের সকল শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ্য হয় । সবাই বলে ইউশা তার দাদার মত হয়েছে । তার দাদা ছিলেন ইংরেজীর অধ্যাপক । ইংরেজীর উপর তার দখল ছিল অবিশ্বাস্য । তার চাচু, সামি (বর্তমানে বিশ্ব্যবিদ্যালয়ে ইংরেজীর প্রভাষক) প্রায়ই বলত, তার ইউশা একদিন তাকে ছাড়িয়ে যাবে ।
মেহযাবিন (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত), ইউশার ফুপু — যার কথা না বললেই নয় । যাকে ঘিরে ইউশার সকল বিনোদন । যার সাথে খেলা করে সময় কাটে ইউশার । ছোট্ট ইউশা তাকে নাম দিয়েছে — বে’ । যে নামের রহস্য আজও অজানা, হয়ত কোনোদিনও জানা যাবেনা ।
জন্ম থেকেই ইউশার শ্বাসকষ্টের সমস্যা । বাচ্চা ছেলেটা অনেক লড়াই করেছে এই সমস্যার সাথে । এর জন্য তাকে কয়েকবার আইসিইউতেও যেতে হয়েছে । যন্ত্রণা পেয়েছে দিনরাত। আর যখনই ইউশার কিছু হতো তখনই পরিবারের সকল সদস্যের ঘুম হারাম হয়ে যেত । তবুও দিন শেষে ইউশাকে নিয়ে তাদের আনন্দের সীমা থাকতো না । ঘরকে আলোকিত করে রাখতো ছোট্ট ইউশা । ইউশার ফুটফুটে মুখের দিকে তাকিয়ে সবাই ভুলে যেত সব কষ্ট । সাজ্জাদ সাহেবের সংসারে সে যেন রহমতের ফেরেশতা ।
ইউশার বয়স এখন দশ বছর । তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র । ছেলেটা এখন আর স্কুলে যেতে পারেনা । শ্বাসকষ্টের সমস্যার জন্য বাসায় বসেই পড়াশোনা করে । দিনগুলো তার সঙ্গীবিহীন কাটে । বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাড়ার ছেলে মেয়েদের হৈ-হুল্লোর দেখে । গলির বাচ্চাদের খেলা দেখে আর খিল খিল করে হাসে । এতেই তার তৃপ্তি । চার দেয়ালের মাঝে সময় গুলো তার বন্দি হয়ে রয় । তবুও আক্ষেপ নেই । কেননা তার ঘরে আছে তার আদরের চাচু আর ফুপু । যারা তাকে খেলার সঙ্গীর অভাব বুঝতে দেয় না ।
হঠাৎ করেই সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যায় । ইউশার সোনালি দিনগুলোতে দুঃখের ছায়া পড়ে । ইউশা জানতে পাড়ে, তার বে-এর বিয়ে হয়ে যাবে । আর কখনো সে তার সাথে বাবু বাবু খেলতে পারবেনা । তাকে প্যান্ট পড়িয়ে দিবেনা কেউ । কেউ আর আদর করে বাবা বলে ডাকবে না । গোসল করার পর শরীর মুছে দিবে না কেউ । ইউশা তার কষ্ট বুঝতে দেয় না কাউকে । মনের কষ্ট মনেই চেপে রাখে । হাসি মুখে বে-কে প্রশ্ন করে, তুমি কি বিয়ের পর চলে যাবা বে ? কতদিন পর আসবে ? তার বে এই প্রশ্নের উত্তর খুজে পায় না ।
ইউশার খেলার একমাত্র সঙ্গী এখন তার চাচু । চাচু টিউশনি শেষ করে তার জন্য পোকেমন কার্ড নিয়ে আসে । তার সাথে রেসলিং খেলে, ঘুরতে বের হয় দুজনে । এই সুখটুকুও যেন সয় না ইউশার কপালে । তার চাচুও বিয়ে করে আলাদা বাসায় চলে যায় । ইউশা নিস্তব্ধ । সে কিছুই বলে না, শুধু তার ছবি আঁকার খাতায় একটি ছেলের ছবি আঁকে । যার চোখ থেকে পানি ঝড়ছে । এই অভিমান সে মনেই চেপে রাখে ।
ইউশা এখন আর খেলে না । শুধু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে । সন্ধ্যা হলে বাবাকে ফোন দিয়ে বলে – আব্বু তুমি কখন আসবে ? তুমি দুপুরে কি খেয়েছো ? ইউশা তার আব্বুর বাড়ি ফেরার আপেক্ষায় বসে থাকে । বাবার গায়ে পা তুলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ।
ইউশা এখন আনেক বড় । পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র । এবার সমাপনী পরীক্ষা দিবে । পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত ।
অনেক দিন পর, ইউশা আজ খুব খুশি । তার ছোট্ট হৃদয়ে আজ আনন্দের বন্য বইছে । বাড়িতে আজ চাচু ফুপু এসেছে । সবাই একসাথে ঈদ করবে । ইউশা তার স্কুলের সকল বন্ধুদের দাওয়াত করেছে । দুপুরে সবাই একসাথে খাবে । এ যেন এক বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস । ইউশা তার পুরনো খেলা গুলো আবার খেলতে পারবে । সেই হারানো সুখ আবার ফিরে এসেছে ।
ঈশ্বরের যেন এ সুখটুকুও সয় না । হঠাৎ করে উলট পালট হয়ে যায় সবকিছু । জীবনের মায়া সাঙ্গ করে – না ফেরার দেশে চলে যায় ইউশা । মরণঘাতী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় সবার চোখের মণি ছোট্ট ইউশা ।
বাইরে মৃদু বাতাস । বৃষ্টি শুরু হয়েছে । অঝোর বৃষ্টি । আকাশের কান্নায় পৃথিবীর বুক ভেসে যাচ্ছে । কিন্তু কিছু মানুষ আজ নিস্তব্ধ, বাকরুদ্ধ । ঈশ্বর তাদের কান্না করার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন।