কিশোর বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, রোববার। বাংলাভাষার শিশু-কিশোরদের জন্য প্রকাশিত হলো একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। অনেকের মতে উপমহাদেশের প্রথম কিশোরদের সাপ্তাহিক পত্রিকা। নাম কিশোর বাংলা। পত্রিকার সম্পাদক নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী। পত্রিকাটির প্রকাশক তৎকালীন দৈনিক বাংলা ট্রাস্ট। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সানাউল্লাহ নূরী। তবে সানাউল্লাহ নূরী ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হলেও মূলত তিনিই ছিলেন কিশোর বাংলার মূল রূপকার। কিশোর বাংলা নামটি তিনিই রেখেছিলেন বলে জানা যায়। মেধা-মননে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য শিশু-কিশোরদের একটি নিয়মিত প্রকাশনার অভাব থেকেই কিশোর বাংলার পরিকল্পনা করেন সানাউল্লাহ নূরী।

সরকারী মহলে তাঁর পরিকল্পনা বোঝাতেও পেরেছিলেন। পথ চলতে শুরু করে কিশোর বাংলা। কিশোর বাংলার পথচলা শুরু হয় সাংবাদিক বোরহান আহমেদ, মোজাম্মেল হক, শিরিন আখতার, মাহবুব হাসান, মুস্তফা মজিদ, আবু সাঈদ জুবেরী, মাযহার আলী, মতিউর রহমান আর শিল্পী আফজাল হোসেন-এর মতো মেধাবী মানুষদের হাত ধরে। শিশুসাহিত্যিক রফিকুল হক (দাদু ভাই), সাইফুল আলম, শাহ আলমগীর ও আবদুর রহমানরা পরে যুক্ত হন।

কিশোর বাংলা প্রকাশিত হতো প্রতি রোববার। কিছুদিন বাদেই পত্রিকাটি অনিয়মিত হয়ে গেল। যদিও পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যারা, তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি কিংবা কাজে অবহেলা ছিল না।

১৯৭৭ সালে সরকারী সিদ্ধান্তে দৈনিক বাংলা ট্রাস্ট থেকে সরে কিশোর বাংলা চলে যায় সাপ্তাহিক চিত্রালীর অধীনে। এরপর থেকে কিশোর বাংলা প্রকাশিত হতে থাকে দৈনিক অবজারভার ভবন থেকে। সম্পাদক ছিলেন পদাধিকার বলে চিত্রালীর সম্পাদক এস এম পারভেজ। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন রফিকুল হক। এস এম পারভেজের অবর্তমানে পরবর্তীতে কিশোর বাংলার সম্পাদক হন আহমদ জামান চৌধুরী।

কিশোর বাংলার প্রথম সংখ্যার লেখক ছিলেন এখলাসউদ্দিন আহমদ, হোসনে আরা, ফয়েজ আহমদ, সুকুমার রায়, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, হুমায়ূন আহমেদ, আলমগীর জলিল, দক্ষিণারঞ্জনমিত্র মজুমদার। কিশোর বাংলায় প্রকাশিত প্রথম উপন্যাসটি ছিল ‘তুনু ও কেঁদো বাঘের গপপো।’ লেখক এখলাসউদ্দিন আহমদ। দেশের কিছু নামকরা উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল কিশোর বাংলায়। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ‘দীপু নাম্বার টু’, আলী ইমাম ‘অপারেশন কাঁকনপুর’, ইমদাদুল হক মিলন ‘চিতা রহস্য’, আমীরুল ইসলাম ‘অচিন জাদুকর’ লিখেছিলেন। গল্প-উপন্যাস-ছড়ার পাশাপাশি কিশোর বাংলায় থাকত মজার মজার ফিচার, প্রবন্ধ। আর থাকত বিভিন্ন শিশুকিশোর সংগঠনের সচিত্র খবর। সবমিলিয়ে কিশোর বাংলাকে ঘিরে একটা লেখকগোষ্ঠী তৈরি হতে থাকল। এই লেখকদের অনেকেই এখন বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের কিংবদন্তী।

শিশু-কিশোরদের স্বপ্নের জগৎ তৈরি করতে পেরেছিল কিশোর বাংলা। পেরেছিল সৃজনশীলতার দুয়ার খুলে দিতে। সৃজনশীলতার সেই দুয়ার থেকে বেরিয়ে অনেক কিশোর, অনেক শিশু পেয়েছিল সাহিত্যের জীয়নকাঠি। এই কিশোর বাংলা হয়েই অনেক কিশোর লেখক কিশোর বাংলার লেখক থেকে দেশের খ্যাতিমান লেখক হয়ে উঠেছেন। তবে বেশিরভাগ পাঠকই পেয়েছিল ম্যাগাজিন পড়ার আনন্দ। কী থাকত না কিশোর বাংলায়! যদিও সাহিত্যনির্ভর পত্রিকাই ছিল কিশোর বাংলা। তবু বিজ্ঞান, কৌতুক, ধাঁধা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস-সবই থাকত। কিশোর পাঠকদের মনের দুয়ারের অনেকখানি জায়গা দখল করতে পেরেছিল কিশোর বাংলা। আর পেরেছিল বলেই সেদিনের অনেক পাঠক আজও কিশোর বাংলা বললেই অন্যরকম হয়ে যান। কিশোর বেলায় ফিরে যাওয়ার অদ্ভুত এক অনুভূতি অনুভব করেন।

সেই কিশোর বাংলা আবার নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। বিশিষ্ট শিশু সংগঠক ও সাংবাদিক মীর মোশাররেফ হোসেন কিশোর বাংলার সম্পাদক। কিশোর বাংলার অতীতের খ্যাতনামা লেখক, কবি, সাহিত্যিক সকলেই নিয়মিত লিখছেন। ইতিমধ্যে দেশের নতুন প্রজন্মের বহু লেখক, কবি, সাহিত্যিক সম্পৃক্ত হয়েছেন। প্রবীণ ও নবীন কবি, সাহিত্যিক, লেখকের মধ্যে সেতু বন্ধন হিসাবে কাজ করছে কিশোর বাংলা। শিশুকিশোর পাঠকদের মনে আবার সেই দোলা দিতে চায় কিশোর বাংলা। কিশোর বাংলা তার ঐতিহ্য ধরে রেখে আবার সৃজনশীলতার বিকাশে কাজ করবে। হাত বাড়িয়ে দেবে দেশের অগণিত শিশু-কিশোরদের দিকে। আর অপেক্ষায় থাকবে, কখন শিশু-কিশোররাও হাত বাড়াবে কিশোর বাংলার দিকে।