একজন যোদ্ধা মায়ের গল্প
মা-বাবার নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে গেছেন এমন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন অগুনতি। দেশমাতৃকার টানে কেউবা যুদ্ধে গেছেন লুকিয়ে লুকিয়ে। আর একই পরিবারের সবাই গেছেন যুদ্ধে- এমন বীরগাথাও কম নয়। তবে, পাঁচ মাসের শিশুসন্তান কোলে কোনো মা মুক্তিযুদ্ধে গেছেন, এমন গৌরবোজ্জ্বল কাহিনী কি খুব একটা মেলে? নিভৃতচারী এই মুক্তিযোদ্ধা খুরশিদ জাহান বেগমের মুক্তিযুদ্ধে যাবার গল্প শুনুন।
যোদ্ধা মায়ের গল্প
একাত্তরের আগুনঝরা সেই দিনে দেশমাতৃকার টানে ঘর ছেড়েছিলেন বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট থানার সৈয়দ মহল্লা গ্রামের মেয়ে, খুরশিদ জাহান । স্থানীয় পিসি কলেজে পড়তেই জড়িয়ে পড়েন ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর তিন মাস পর নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে পাঁচ মাসের শিশু আসাদুজ্জামান তাজকে কোলে নিয়ে চলে যান সুন্দরবনের গহীনে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। শিশু সন্তানের কারণে সম্মুখ যুদ্ধে যেতে না পারলেও সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের। কাঁধে রাইফেল, কোলে শিশুপুত্র তাজ আর কোমরে ছুরি নিয়ে ডিঙি বেয়ে ঘুরেছেন সুন্দরবনের এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে। এসব ক্যাম্পে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার যোগান থেকে শুরু করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন এই নারী। খুলনা শহরের টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের এ এন দাস লেনে এখন নিভৃতে বসবাস করছেন তিনি। সুন্দরবনের সে দিনগুলি নিয়ে লিখেছেন ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার কিছু স্মৃতিচারণ ও আত্মোপলব্ধি’। এছাড়া লিখেছেন আরো দুটি বই, ‘একাত্তরের যুদ্ধশিশু’ এবং ‘বীরঙ্গনা না মুক্তিযোদ্ধা’ (উপন্যাস)। তার জবানীতেই শোনা হলো বীরত্বের সেই কাহিনী।
মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের খোঁজে
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই আমাদের গ্রামের বাড়িতে হানা দিলো রাজাকাররা। আমার ভাই পাকিস্তান আর্মিতে ছিলেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে ছুটিতে দেশে এসে আর ফিরে যাননি। আমাকে আর আমার ভাইকে খুঁজতে লাগলো তারা।
এ সময় শুরু হয় আমার পলাতক জীবন। খুঁজতে থাকি মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। খুঁজতে খুঁজতে জুন মাসে আমি আর আমার ভাইজান চলে যাই সুন্দরবনের গভীরে তাফালবাড়ি ক্যাম্পে। কোলে আমার পাঁচ মাসের শিশুপুত্র তাজ।
তাফালবাড়ি ক্যাম্পে পৌছে দেখি এলাহী কাণ্ড। নানা বয়সী শত শত মুক্তিযোদ্ধা। কাঁধে বন্দুক, হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরা। সবাই খুব ব্যস্ত। ভাইজান সেনাবাহিনী থেকে আসা শুনে অনেকেই এসে ভাইজানের কাছে ভিড় জমাতে লাগলেন।
বেলা ১২টায় এলেন সাবসেক্টর কমান্ডার জিয়াউদ্দিন। আমাকে বললেন, আপনাদের ট্রেনিং আজ এবং এখনি শুরু হবে। আপনি তৈরি? আমি বললাম, আমি তৈরি।
অস্ত্র প্রশিক্ষণ
প্রথমেই হ্যান্ড গ্রেনেড কীভাবে চালাতে হয়, তা শেখানো হলো। প্রতিদিন সকাল বিকাল দুই বেলা ট্রেনিং হতো।
সকাল-বিকাল প্রশিক্ষণের পর আমি খাতায় লেখা প্রশিক্ষণের নিয়ম-কানুন মুখস্ত পড়তাম। হ্যান্ড গ্রেনেড থেকে শুরু করে থ্রি নট থ্রি, এসএলআর, এসএমজি, এলএমজি, ল্যান্ড মাইন ইত্যাদি চালানোর প্রশিক্ষণ নেই। তাফালবাড়ি ক্যাম্পের পাশে ওয়াপদা বাঁধের উপর চলতো এই প্রশিক্ষণ। প্রচ- আগ্রহ এবং উৎসাহে অল্প সময়ের মধ্যেই আমার বেশ অগ্রগতি হলো।
টানা ১০ দিন চলল আমাদের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। ট্রেনিং শেষে আমাদের মূল ঘাঁটি তেতুলবুনিয়া (স্থানীয় ভাষায় তেতুলবাড়িয়া) নিয়ে যাওয়া হলো। তেতুলবাড়িয়া নদীর দুই পাশে প্রত্যেকটা খাল, শাখা প্রশাখা মিলে প্রায় চার মাইল জায়গা জুড়ে সুন্দরবন সাবসেক্টরের ঘাঁটি ছিলো। সেখানে প্রায় ১৪ হাজার সৈনিকের খাওয়া-দাওয়া প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা সব কিছুরই ব্যবস্থা ছিল।
তবে প্রশিক্ষণের পরপর কিছুদিন কাজ ছিল একদমই কম ছিল। এ সময় জিম্মায় থাকা অস্ত্রগুলো বারবার খুলে পরিষ্কার করে সময় কাটতো। এ সময় মুখস্ত করতে থাকি যন্ত্রাংশের নামও। কোন পরিস্থিতিতে কোনটা ব্যবহার করতে হবে, রপ্ত করি তাও।
যুদ্ধ শিশু
প্রশিক্ষণ চলার সময় আমার ছেলে তাজ শুয়ে থাকতো গোলপাতা বিছানো ছোট্ট জায়গায়। আমার কোলে আসার জন্য কখনো কখনো জোরে জোরে কাঁদতো। কিন্তু, প্রশিক্ষণের জন্য তাকে আদর করার সময়ও পেতাম কম।
প্রশিক্ষণের সময়ে শিশু তাজ এর দেখভাল করতো সালাম নামের আরেক শিশু। বয়স তার আট কি দশ হবে! তাজও ছেলেটাকে বেশ পছন্দ করে ফেলে। অল্প কয়দিনের ভেতরই ছেলেটা ফিডার পরিষ্কার করা, দুধ বানানো, তাজকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সবই শিখে নেয়। ফলে তাজের জন্য আমার বিশেষ সময় দেওয়া লাগতো না। তাজকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, বাইরে হাঁটতে যাওয়া, সবই সালাম বেশ রপ্ত করে ফেললো।
হাজার হাজার যোদ্ধার ক্যাম্পে একমাত্র শিশু ছিলো তাজ। আমার ছোট্ট শিশুটি ছিলো ক্যাম্পের প্রাণ। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই সন্তান বা ছোট ভাই-বোন ফেলে যুদ্ধে গিয়েছিল। ক্যাম্পে এসে সবাই তাই খোঁজ করতো তাজ-এর। আনন্দের উৎস ছিলো তাজ।
যুদ্ধে যাওয়ার আকুতি
প্রশিক্ষণ দেওয়া, যোদ্ধাদের জন্য রান্নাবান্না-কাপড় সেলাই বা গোয়েন্দাগিরি- এভাবেই কাটছিলো গহীন অরণ্যের দিনগুলি। যুদ্ধে যাবার আকাঙ্ক্ষায় আমি এতটাই পাগল হয়েছিলাম যে, একদিন রাতে ডিঙি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সুন্দরবনের খাল পেরিয়ে চলছে ডিঙি, দু’পায়ের ফাঁকে ঘুমন্ত তাজ। কাঁথায় মোড়া, কাঁধে রাইফেল, কোমরে ছুরি। চলে গেলাম রায়েন্দা বাজার ক্যাম্পে থাকা বোটে। তাজকে ডিঙিতে রেখেই বোটের জানালা দিয়ে ঢুকে চুরি করলাম সাবসেক্টর কমান্ডার জিয়াউদ্দিন এর জ্যাকেট-ট্রাউজার। সকালে মুখ ঢেকে ‘চোরাই’ জ্যাকেট-ট্রাউজার পরে ছেলেদের সঙ্গে প্যারেডে দাঁড়ালাম। কিন্তু, ধরা পড়ায় যুদ্ধে যাওয়া হলো না।
একদিন সাবসেক্টর কমান্ডার জিয়াউদ্দিনকে বললাম- গুলি করা, গ্রেনেড চার্জ করা সবই তো শিখলাম। এবার আমি যুদ্ধে যেতে চাই।
তিনি বললেন, যে কাঁধে রাইফেল নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছে সে যেমন একজন যোদ্ধা, তেমনি যোদ্ধার খাবার যারা যোগান দিচ্ছে, প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে, তারাও মুক্তিযোদ্ধা।
নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অধিনায়ক
কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দিলেন সাবসেক্টর কমান্ডার জিয়াউদ্দিন। বললেন, নিজের অস্ত্র কখনো কাছ ছাড়া করবেন না। নিজের সন্তানকে যেমন যতœ করেন, তেমনি অস্ত্রগুলিও প্রতিদিন পরিষ্কার করে তেল দিয়ে ঝকঝক করে রাখবেন। রাতে ঘুমানোর সময়ে তাজ ঘুমাবে একপাশে, অন্যপাশে রাখবেন অস্ত্র।
নতুন যোগ দেওয়া সৈনিকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধের কলাকৌশলসহ নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অবহিত করা, অপারেশনে যাবার সময়ে সৈনিকদের রুটি তৈরি, সৈনিকদের ব্যবহারের জন্য লুঙ্গি এবং ফতুয়া সেলাই, হাসপাতালের জন্য মশারী সেলাই, যুদ্ধাহত রোগীদের সেবা এবং ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে সেগুলোর অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট করার দায়িত্ব বর্তালো আমার ওপর।
এ সময় ছেলেকে পায়ের মধ্যে বসিয়ে কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে ডিঙি নিয়ে ঘুরতাম ক্যাম্পে ক্যাম্পে। কোমরে থাকতো ছুরি।
নতুনদের প্রশিক্ষণ
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রুটি বানানো, লুঙ্গি সেলাই করার পাশাপাশি নতুনদের অস্ত্র চালানো প্রশিক্ষণও দিতে হতো আমাকে।
প্রথমদিকে ভাইজান, আমি, আফজাল কমান্ডারসহ আরো দুই-একজন ভাগ করে বেলা ১২টা পর্যন্ত ট্রেনিং করাতাম। প্রশিক্ষণ শেষে লেগে যেতাম যোদ্ধাদের জন্য খাবার তৈরিতে, এভাবে চলতো রাত পর্যন্ত।
অভিযানে গেলে ফলাফলের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম আমরা। যুদ্ধে না যাওয়ার কষ্ট ছিল। তবে ২/৩ দিন পর যখন ওরা যুদ্ধে জিতে ফিরতো, খুব ভালো লাগতো। রায়েন্দাবাজার অপারেশনে আমাদের সাবসেক্টরের আসাদ, পিটু, আলমগীর, ধ্রুপদ, চানমিয়াসহ ছয় জন শহীদ হন। তখন আমরা বেশ ভেঙে পড়েছিলাম।
জঙ্গলের জীবন
সুন্দরবনে যাওয়ার পর প্রথম প্রথম বোটে থাকতাম। একদিন মৌমাচির গুনগুন আওয়াজের মতো শুনলাম। ভাবলাম শত্রুর আক্রমণ। বাচ্চা কোলে আমি আর সালাম দৌড়ে সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকে গেলাম। দুপুর বেরিয়ে কখন যে সন্ধ্যা নেমে এলো। আমরা আর ফেরার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। গাছে হেলান দিয়ে কাঁদতে থাকলাম। এমন সময় হ্যান্ডমাইকে আওয়াজ শুনলাম, আমাদের খোঁজা হচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে আমি আকাশে দুই রাউন্ড গুলি করলাম। গুলির শব্দ শুনে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের অবস্থান সনাক্ত করে আমাদের উদ্ধার করলেন।
নভেম্বরে পড়লাম আরেক বিপদে। খবর পেলাম, তেতুলবুনিয়ায় আমাদের ডিঙি ডুবে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। নেভি অফিসার মাহতাবসহ কয়েকজন মারাত্মক আহত। তাজকে ডিঙি নৌকায় নিয়ে আমি সুবেদার গাফফার, আসাদ (স্বাধীনতার কিছুদিন আগে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন) এবং রতন রওয়ানা দিলাম। ডিঙি নৌকা চলছে খাল দিয়ে।
ভাটির সময় নৌকা বেশি জোরে আগাচ্ছে না। একটু পর দেখলাম আকাশে উড়ছে একটি প্লেন। দূরে গানবোটের শব্দ পেলাম। এমন সময় শুরু হলো বৃষ্টির মতো গুলি।
রতন বললো, আপনি তাজকে নিয়ে নিচে নামেন। সবাই ছুটলাম আশ্রয়ের জন্য। বনের ভেতর একটি বড় গাছের ফাঁকা গুড়িতে আশ্রয় নিলাম। গোলাগুলি তখনো থামেনি। সন্ধ্যা হয়ে গেলো। জোয়ারে পানি বাড়তে লাগলো।
পানি যতো বাড়ছে আমি তাজকে ততো উপরে তুলছি। সমস্ত শরীরে কিলবিল করতে লাগলো পোকা। রাত ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আমার নড়াচড়ার শক্তিও যেন আর রইলো না। মনে হচ্ছিলো প্যারালাইজড হয়ে গেছি। মাহতাবদের ক্যাম্পে আর যাওয়া হলো না। রাত ১২টায় ফিরে এলাম তেতুলবাড়িয়া সদর দপ্তরে।
বাড়ি ফিরে নতুন সংগ্রাম
দেশ স্বাধীন হবার পর ২২শে ডিসেম্বর ছয় মাসের জঙ্গল জীবন ছেড়ে আমি আর ভাইজান আমাদের বাড়ি ফকিরহাটে ফিরে যাই। আমার স্বামী সামসুল আলম তালুকদার ছিলেন সাবসেক্টরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। উনি থেকে যান সুন্দরবন।
সামসুল আলম করতেন ন্যাপ। বাগেরহাট পিসি কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
স্বাধীনতার পর স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়ি বরিশালে চলে যাই। ছোট তাজকে নিয়ে ভালোই চলছিলো দিনগুলি। কিন্তু, হঠাৎই সব পাল্টে যেতে লাগলো। বরিশালের স্থানীয় রাজনীতির কারণে ফিরে আসতে হলো বাগেরহাটে।
মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে এলাকায় আমি নিন্দিত হয়েছিলাম। আজকের প্রজন্ম চিন্তাই করতে পারবে না কতটা সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে আমার।
স্বাধীনতার পর চাকরি পাই সোনালী ব্যাংকে। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নয়, নিজ যোগ্যতায়।
অনেক কষ্ট করে বড় করেছি তিন ছেলেকে। সেই ছোট্ট তাজ এখন চাকরি করে অক্সফামে। অন্য দুই ছেলে ব্যবসা করছে খুলনায়।
অনেক রাজাকারই মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র পেয়েছে। আমি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সনদপত্র পাইনি। অবশ্য তার জন্য খুব একটা দুঃখিত নই।