আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা: শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সর্ম্পকের পরিবর্তন

তুষার আবদুল্লাহ: একজন ছাত্রের কাছে সব থেকে শ্রদ্ধাভাজন তার শিক্ষক । এই শিক্ষকের হাতেই গড়ে ওঠে তার সকল নৈতিক মূল্যবোধের কাঠামো । সফল ও সুন্দর ভবিষ্যতের কারিগর এই শিক্ষক । কখনো কখোন সবকিছু ছাপিয়ে একজন শিক্ষক হয়ে উঠেন আদর্শের মাইলফলক । শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি কর্ম জীবনেও থেকে যায় এই আদর্শের ছাপ । সঠিক আদেশ, উপদেশ আর স্নেহময় ভালোবাসা দিয়ে একজন ছাত্রের জীবনকে সফলতার দিকে অনেক ধাপ এগিয়ে দেন শিক্ষক । ঠিক একইভাবে ছাত্রারাও শিক্ষকদের স্থান দেন পিতার আসনে । দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমাদের দেশের শিক্ষকরা অনেক বেশি মর্যাদা এবং সম্মান পেয়ে থাকেন । শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুসর্ম্পক বাড়িয়ে দেয় শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ । শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে তৈরি হয় সেতু বন্ধন।
কিন্তু অনেক সময় আমরা এর ব্যতিক্রমও দেখতে পাই । আধুনিক সংস্কৃতির ছোঁয়ায় একদিকে যেমন জীবন ব্যবস্থায় এসেছে পরিবর্তন তেমনি শিক্ষার্থী – শিক্ষকের সর্ম্পকেও এসেছে নতুন মাত্রা । শ্রেণীকক্ষের বাইরে এখন আর শিক্ষার্থী – শিক্ষকের মাঝে তেমন সুসর্ম্পক ল্যক্ষ করা যায় না । পুঁজিবাদি এই অর্থনৈতিক জীবনে বেড়েছে চাহিদা, যা জন্ম দিয়েছে বহুমুখী ব্যবসার ।আজ শিক্ষকরা ছুটছেন টাকার পেছনে আর ছাত্র শিক্ষকের সর্ম্পক নির্ধারীত হচ্ছে অর্থের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ । যেখানে সামাজিক কাঠামো একটি মধ্যবিত্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় । যোগানের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে চাহিদা । অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর কুসংস্ককার আকড়ে আছে  প্রত্যেকটা সমাজ ব্যবস্থার শিকড়ে । যেখানে প্রায় অর্ধেক জনগনই সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত এবং প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক  নিরক্ষর । আর এমন একটা দেশের সমাজ ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে এবং সামাজিক উন্নয়নকে তরান্নিত্ব করতে একজন শিক্ষকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । কয়েক বছের আগেও আমরা এমন কিছু শিক্ষক পেয়েছি যারা শিক্ষকতার পাশাপাশি অনেক সমাজসেবামূলক কর্মকান্ডে জরিত ছিলেন । বিনামূল্যে পাঠদান, নিজ উদ্যোগে লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যতিক্রমধর্মী বিনোদনের ব্যবস্থা – ইত্যাদি ছিল তাদের নেশা। পাশাপাশি সমাজ সংস্কারেও তাঁরা নানা কার্যক্রম হাতে নিতেন ।কিন্তু বর্তমানে তা শুধুই খবরের কাগজে কালে ভদ্রে পাওয়া যায় । শিক্ষকদের মানসিকতার যে পরিবর্তন আসছে তা আমরা সহজেই উপলদ্ধ্বি করতে পারছি।
আমি মনে করি, একজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে একমাত্র বিনিময়ের মাধ্যম হচ্ছে জ্ঞান । একটা সময় ছিল যখন শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছাকাছি থেকে শুধুই জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করত । আজ শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে পরিবর্তন । শিক্ষকদের চিাহিদা এখন আর্থিক মুক্তি আর শিক্ষার্থীর চাহিদা কিছু সার্টিফিকেটস । শিক্ষা আজ কোচিং ব্যবসার খাচায় বন্দী । শিক্ষকরা জিম্মী পুঁজিবাদি অথর্নীতির কাছে।
আধুনকি সভ্যতার বদৌলতে সামাজিক সর্ম্পকের পরিধি বিস্তৃত হলেও পালটাচ্ছে সর্ম্পকের ধরন ।শিক্ষার্থী শিক্ষকের সর্ম্পক আর সেই জায়গায় নেই । অতি-আধুনিকতা কেড়ে নিয়েছে নৈতিক মূল্যবোধ উপহার দিয়েছে এক বহুমাত্রিক সর্ম্পকের বলয় । যেখানে শিক্ষকরা আজ সকল নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে শোষণ করছেন শিক্ষার্থীদের । এ শোষণ কখনো আর্থিক, কখনো মানসিক আবার কখনো শারীরিক । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়েছে যৌন হয়রানি ও যৌন প্রতারনামূলক কর্মকান্ড । প্রায় প্রতিদিনিই খবরের শিরোনাম হচ্ছে নানা অপ্রতিকর ঘটনা । কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে খেলা করছেন বিদ্বান রুপী দুর্জনরা । ভাল ফলাফলের আশায় কখনোবা প্রেমের নেশায় এ সব ফাদে পা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
শুধু তাই নয়, মানুষ গড়ার কারিগররা জড়িয়ে পরছেন নানা রকম দূর্নীতি, অনিয়ম আর অন্যায়ের সাথে । নৈতিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের পরিবর্তে তারা বেছে নিয়েছেন ক্ষমতার আধিপত্যকে । নিজেদের যুক্ত করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘঠনের সথে । সস্তার বাজারে বিকিয়ে দিচ্ছেন সকল নীতি-নৈতিকতা । শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলার পরিবর্তে নিজেরাই জরাচ্ছেন নানা বিতর্কে । এর কালোছায়া পড়েছে সমগ্র শিক্ষা পদ্ধতির উপর যা তীলে তীলে সংক্রমিত হয়ে অসুস্থ করে তুলছে গোটা সমাজকে । শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষক, শিক্ষাথী ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবগ কেউই রেহাই পাচ্ছেন না সমালোচনার তীর থেকে । কেউ কেউ সমগ্র শিক্ষা পদ্ধতিকে পরিবর্তন করার কথা বলছেন, কেউ আবার ঢেলে সাজানোর পক্ষে । কিন্তু আদৌতে কোন সমাধান আসবে কিনা আমার জানে নেই । যেখানে সমস্যা, সেখানেই সমাধনটা খুজতে হবে । নৈতিক মূল্যবোধ কে জাগিয়ে তুলতে হবে, আনতে হবে মানসিকতায় পরিবর্তন, সমাজে সুচিন্তার চর্চা বাড়াতে হবে । এ উদ্যেগ শিক্ষকদেরই নিতে হবে।
এই চলমান ত্রুটির্পূণ অবস্থা যদি র্দীঘ সময় ধরে চলতে থাকে তাহলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধ্বংস অনির্বায । যার প্রভাব পড়বে শিক্ষার্থীদের উপর যারা আগামী দিনের কর্নদার । যাদের হাতে আগামীর সম্ভাবনা তাদের যদি সঠিক পথের সন্ধান দিতে না পারি তাহলে আমাদের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে । ভেঙ্গে পরবে সামাজিক কাঠামো যার সূদুঢ় প্রসারি প্রভাব জাতি হিসেবে আমাদের অগ্রযাত্রা টেনে ধরবে ।
এখান থেকে উত্তরণ পেতে চাইলে, শিক্ষক সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে । শিক্ষকরাই মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে সমাদৃত, সুতরাং তারাই পারবেন শিক্ষার্থীর মনের সকল অশুভ চিন্তা দূর করে সমাজকে সুন্দর পথে পরিচালিত করতে । আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ম অনুযায়ী যেহেতু ছাত্র ছাত্রীরা দিনের অধিকাংশ সময়ই স্কুল, কলেজ, কোচিং এ থাকে, সেহেতু তাদের মানসিক বিকাশে বড় অবদান রাখার সুযোগ পান এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা । আমি কোচিং ব্যবস্থার বিপক্ষে নই । কেননা জ্ঞান অর্জনের কোন সীমানা নেই । কোচিং, প্রাইভেট টিউশন থেকে শিক্ষার্থীরা যদি কিছু শিখতে পারে তবে মন্দ কি । এ ক্ষেত্রে কোচিংগুলোকে বেশি সতক ভূমিকা পালন করতে হবে । ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জন ও মূল্যবোধ বিকাশে আরও সচেষ্ট হতে হবে ।
শিক্ষকদের মনে রাখতে হবে আমাদের সমাজে পিতা মাতার পরেই তাদের অবস্থান । একজন ধর্মীয় নেতার মতই আমরা শিক্ষদের আদেশ নির্দেশ মেনে চলি । তাই সকল প্রকারের লোভ লালসা পরিত্যাগ করে সমাজকে সুন্দর ও সত্যের দিকে পরিচালিত করতে হবে । নিজের নৈতিক চরিত্রকে সত রাখার পাশাপাশি ছাত্র ছাত্রীদের সুন্দর আখলাক গঠনে শিক্ষকরাই মূখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখতে শিক্ষার্থীরাও গুরুত্বর্পূণ আবদান রাখতে পারে । তাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে, আমাদের সংস্কৃতি ঐতিহ্যমন্ডিত, পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে গ্রহন করার মাঝে গৌরবের কিছু নেই । পারস্পারিক শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ প্রদর্শনের মাধ্যমেই আমরা সফল ও গৌরবময় ভবিষ্যৎ গঠন করতে পারবো । ছাত্র ছাত্রীরা যদি তাদের অধ্যবসায় ও কঠোর সাধনার সাথে শিক্ষকদের সঠিক দিক নির্দেশনার সমন্বয় ঘটাতে পারে তাহলেই কেবল তাদের ছাত্রজীবন সার্থক হবে । এক্ষেত্রে অবিভাবকদের মাথায় রাখতে হবে, শুধু একাডেমিক সার্টিফিকেটস কখনোই সফলতার মাপকাঠি হতে পারে না । একজন শিক্ষার্থীর সবচেয়ে বড় অর্জন তার জ্ঞান । শিক্ষকদের প্রতি অধিক শ্রদ্ধাশীল হওয়ার দিক্ষাও পরিবার থেকেই দিতে হবে ।
সর্বপরি এই সকল উদ্যোগকে একটা নির্দিষ্ট কাঠমোর মধ্যে নিয়ে এসে এমন এক শিক্ষা পদ্ধতি প্রনয়ন করতে হবে যা আধুনিক বিশ্বের কাছে রোল মডেল হয়ে থাকবে । এ ব্যাপারে সরকারকে তার শিক্ষানীতি গ্রহন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সতর্ক ভূমিকা রাখতে হবে । শিক্ষা জাতীর মেরুদন্ড, এই মেরুদন্ডকে সমুন্নত রাখতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে হতে হবে শৃজনশীল, জ্ঞানমূলক এবং সকল প্রকার অনিয়মের উর্ধ্বে । তবেই কেবল শিক্ষক শিক্ষার্থীর সর্ম্পককে পুঁজিবাদি শোষনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব ।