ক্রমবর্ধমান কিশোর অপরাধ – একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি

কিশোর বাংলা প্রতিবেদন: সারা বিশ্বে ক্রমবর্ধমানহারে কিশোর অপরাধ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ফলে এটি অল্প সময়ের মধ্যেই মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি হিসাবে পরিণত হতে পারে। যা একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণের পক্ষে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সুস্থ দেশ, জাতি ও শান্তিময় বিশ্ব গঠনের লক্ষ্যে এ প্রবন্ধে কিশোর অপরাধের নানা কারন এবং তা প্রতিকারের উপায় তুলে ধরছি।

অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে কর্তৃক সংঘঠীত দেশীয় আইন, সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী কর্মকান্ডকেই কিশোর অপরাধ বলে। কৈশোরকাল মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

কিশোর অপরাধের সুনির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন। তথাপিও অপরাধবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিশোর অপরাধের কারণ অনুসন্ধানের প্রয়াস চালিয়েছেন। যা অপরাধের নানাবিধ সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে ধারণা লাভে সহায়ক।

ধর্মহীনতা

কিশোর অপরাধের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আরনল্ড টয়েনবী অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, বর্তমানের ধর্মহীনতাই অন্যান্য অপরাধের ন্যায় কিশোর অপরাধের কারণ।

সামাজিক পরিবেশ

সমাজবিজ্ঞানী হিলি এবং ব্রোনোর কিশোর অপরাধের কারণ হিসেবে সামাজিক পরিবেশের প্রভাবকে চিহ্নিত করেছেন। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড কিশোর অপরাধের কারণ অনুসন্ধানে বাহ্যিক পরিবেশের পরিবর্তে মানুষের মনোজগতের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। বংশগতি বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জৈবিক বৈশিষ্ট্য কিশোর অপরাধের অন্যতম একটি কারণ।

অপরাধশারীরিক ও মানসিক

জন্মগতভাবে শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে তা স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে তারা অপরাধমূলক কর্মে জড়িয়ে পড়ে। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ড. হিলি শিকাগো শহরে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, কিশোর অপরাধীদের ৩১% এর দৈহিক বিকাশ অস্বাভাবিক। এছাড়াও ইতালিতে সাম্প্রতিক গাবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, দৈহিক অক্ষমতা দূর করা গেলে কিশোরদের অপরাধমূলক আচরণ থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।

পরিবার

কিশোর অপরাধ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সব সময় পরিবারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। কেননা পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূল ভিত্তি। পরিবারের সূচনা হয় স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমে আর পারিবারিক পরিমন্ডলে সন্তানের জন্ম হয় এবং বিকাশ লাভ করে। সন্তানের স্বাভাবিক ও সুস্থ বিকাশের জন্য পিতামাতার মধ্যে সম্প্রীতিময় দাম্পত্য জীবন একান্ত অপরিহার্য। পিতা-মাতার মধ্যে মনোমালিন্য ও কলহ বিবাদ থাকলে সন্তানের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে, যা পরিণামে শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণ হতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।

অর্থনৈতিক প্রভাব

অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের জনক কার্ল মার্কস এর মতে, কিশোর অপরাধসহ সব ধরনের অপরাধের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক প্রভাব। অর্থনৈতিক অবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে কিশোর অপরাধের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। দারিদ্র ও সম্পদের প্রাচুর্য উভয়ই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভবে কিশোর অপরাধ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দারিদ্রতার কারণে মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে কিশোররা বিভিন্ন প্রকারের অপরাধে লিপ্ত হয়ে থাকে।

বন্ধু বান্ধবের প্রভাব

কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে সঙ্গদলের প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিশোর-কিশোরীরা এই বয়সে পরিবারের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে চলতে চায় এবং পাড়া-প্রতিবেশী, খেলার সাথী, সমবয়সীদের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এ ধরনের সম্পর্কের মাধ্যমে শিশু-কিশোররা অত্যন্ত সহজে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতে পারে, যা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন বা পরিবার-পরিজনের নিকট থেকে করতে পারে না।

কিশোর অপরাধ প্রতিকারের উপায়

সঠিক পন্থার শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ না হওয়ার কারণেই মূলত কিশোর অপরাধ সংঘটিত হয়। এছাড়াও যেসব কারণে এই ব্যাধির সৃষ্টি হয়, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কিশোর অপরাধ প্রতিকার করা সম্ভব।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বলতে বুঝায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে যাতে প্রথম থেকেই অপরাধ প্রবণতার সৃষ্টি না হয়, তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করা। যেসব কারণে শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা দেখা যায়, সেগুলোকে আগে থেকে দূর করাই এ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের উত্তম স্থান হলো পরিবার। জন্মের পর শিশু পারিবারিক পরিবেশ মাতা-পিতার সংস্পর্শে আসে। শিশুর সামাজিক জীবনের ভিত্তি পরিবারেই রচিত হয়। তাই তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

বিশেষ করে এক্ষেত্রে পিতা-মাতার ভূমিকা অপরিসীম। কেননা তারাই সন্তানদের অনুপম চরিত্র গঠনে কার্যকর অবদান রাখতে পারেন।

মাতা-পিতা সন্তানকে ঈমানের শিক্ষা, ইসলামের যথার্থ জ্ঞান দান করবে এবং তাদের অনুসন্ধিৎসাকে জাগিয়ে তুলবেন। যাতে করে তারা অর্জিত জ্ঞানের দ্বারা ভালো-মন্দের, ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য নিরুপণ করতে পারে এবং নিজেদেরকে অপরাধকর্ম থেকে বিরত রাখতে পারে।

শিশু-কিশোররা যে সমাজে বসবাস করে সে সমাজেরও রয়েছে অসংখ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। সমাজে যদি অন্যায়-অনাচার অবাধে চলতে থাকে, তাহলে শিশু-কিশোররা তা অনুসরণ করে অপরাধপ্রবণ হতে পারে। ফলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলার ব্যঘাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সমাজ থেকে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ করতে হলে কেবলমাত্র শিশু সমাজকে উন্নত করলেই চলবে না, বরং সমগ্র সমাজের উন্নয়ন করতে হবে। সমাজের নৈতিক আদর্শ, পারস্পরিক আচরণ, কর্তব্যপরায়ণতা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *